অবসরের বয়সে নিয়োগপত্র শিক্ষকদের
২০ জানুয়ারি ২০২৪স্কুলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ ঘিরে একগুচ্ছ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি এখনো। হাজারদিনের বেশি অবস্থান আন্দোলনে রয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। এরই মধ্যে সামনে এল প্রাথমিক স্কুলে নিয়োগের এক খবর। আদতে যা একঝাঁক 'তরুণের' স্বপ্নকে হত্যার করুণ কাহিনি।
নিয়োগের পরিহাস
এই কাহিনীর সূচনা চার দশক আগে, যখন রাজ্যে সদ্যই ক্ষমতায় এসেছে বামফ্রন্ট সরকার। আশির দশকের গোড়ায় হুগলি জেলায় প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। তখন পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগের পদ্ধতি ছিল না, ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে বেছে নেয়া হতো শিক্ষকদের।
এই বাছাই নিয়ে বিরোধ তৈরি হওয়ায় মামলা দায়ের করেন কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী। তারা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্যানেল বাতিলের আবেদন জানান। ১৯৮৩ সালের সেই মামলা হাইকোর্টে চলছিল। এই মামলার নিষ্পত্তি হয় গত ২০ ডিসেম্বর।
বিচারপতি সৌম্যেন সেন চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের নির্দেশ দেন, সেই অনুযায়ী নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে হুগলি জেলার ৬৬ জনকে। এই নিয়োগ কার্যকর হওয়ার দিন ২০১৪ সালের ৮ আগস্ট।
জেলা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নিয়োগপত্র পেয়ে বিস্মিতসেই 'তরুণ' চাকরিপ্রার্থীরা। আজ যারা পক্বকেশ বৃদ্ধ। ৬৬ জনের মধ্যে চারজন প্রয়াত। বাকিদের ৬০ বছর পেরিয়েছে, যা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের বয়স। এদের কারো বয়স ৭০ পার হয়ে গিয়েছে।
প্রবীণদের হতাশা
প্রাথমিকে নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পর বিস্মিত জাঙ্গিপাড়ার দেবব্রত ঘোষ, পাণ্ডুয়ার দীনবন্ধু ভট্টাচার্য, পুরশুড়ার প্রশান্তকুমার ঘোষরা। আবেদনকারীদের অন্যতম স্বপনকুমার ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন ২০১৮ সালে। তার পরিবারও নিয়োগপত্র পেয়ে অবাক।
স্বপনের স্ত্রী মাধবী বলেন, "আমাদের লুকিয়ে মামলার খরচ জোগাতেন। বলতেন, মামলা জিতলে চাকরি পাবেন। আজ চাকরির চিঠি এল, কিন্তু উনি নেই। টাকার অভাবে ওর চিকিৎসা ঠিকঠাক করানো যায়নি।"
দেবব্রত ঘোষ বলেন, "১৯৮০ সালে প্রাথমিকে শিক্ষকতার জন্য জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং নিয়েছিলাম। তারপর স্কুলে চাকরির জন্য আবেদন করি। ইন্টারভিউ হয়েছিল। আমাদের নম্বর ভালো থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পাইনি। একাধিকবার ইন্টারভিউ দিলেও পাশ করানো হয়নি।"
চাকরির জন্য এখন আর উচ্ছ্বাস থাকার কথা নয়। তবু আইনি লড়াই জিতে বৃদ্ধরা খুশি। প্রশান্তকুমার ঘোষ বলেন, "এটা আমাদের নৈতিক জয়, সত্যের জয়। তবে এখন আর চাকরি পেয়ে লাভ নেই। যা যন্ত্রণা ভোগ করার আমরা করেছি। এখন শুধু এটুকুই আবেদন, যাতে শেষ বয়সে আর্থিক কষ্ট না হয়, সেটা যেন মানবিকভাবে কর্তৃপক্ষ দেখেন।"
বেকার জীবনের সংগ্রামের স্মৃতি সকলকে তাড়িয়ে বেড়ায়। হুগলির চাকরিপ্রার্থী কালীধন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "একসময় খুব কষ্ট করে সংসার চালিয়েছি। ভালো ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি মিলবে না, সেটা ভাবিনি। এখন দুই মেয়ে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটাই সান্ত্বনা। এখন আর এই চাকরি দিয়ে কী করব? কেউ তো আমাদের সময়টা ফিরিয়ে দেবে না!"
দীর্ঘ আইনি লড়াই
চাকরি না মেলায় একঝাঁক চাকরিপ্রার্থী হাইকোর্টে প্যানেল বাতিলের আবেদন জানান। তাদের পক্ষে রায় আসে। সিঙ্গল বেঞ্চের রায় ডিভিশন বেঞ্চে খারিজ হয়ে যায়। এরপর সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানান প্রার্থীরা। শীর্ষ আদালত বিষয়টি হাইকোর্টেই নিষ্পত্তির জন্য পাঠায়। শেষমেশ এই আদালতেই চাকরিপ্রার্থীদের দাবি স্বীকৃতি পেয়েছে।
ভারতীয় বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা বহুদিনের সমস্যা। মামলার নিষ্পত্তিতে বহু বছর লেগে যায়। অনেক সময় মামলাকারীরা আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেন না, মামলার খরচ জোগানো দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। হুগলির এই চাকরিপ্রার্থীরা হাল ছাড়েননি, তার ফল মিলেছে চার দশক পর।
চিরকুটে চাকরি
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পশ্চিমবঙ্গের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন জেলবন্দি। তার আমলের একাধিক শিক্ষাকর্তাও কারাগারে। এ নিয়ে বিরোধীরা নিশানা করছে শাসক দল তৃণমূলকে। তারাও নিয়োগ দুর্নীতির কথা বলতে বাম আমলের প্রসঙ্গ টেনে আনছে।
তৃণমূলের দাবি, সিপিএমের শাসনে যখন নিয়োগের পরীক্ষা নেয়া হতো না, তখন চিরকুটে লিখে পরিবার-পরিজন ও দলীয় কর্মীদের চাকরি দিয়েছে শাসক দল। হুগলির ঘটনায় সেই চিরকুটের প্রসঙ্গই ফের উঠে এল।
মামলায় জেতা প্রবীণ দীনবন্ধু ভট্টাচার্য বলেন, "১৯৮৩ সালের কথা। পুজোর ছুটির ঠিক আগে চিরকুটে লিখে বামফ্রন্ট সরকার চাকরি দিয়েছিল, যাতে ছুটির মধ্যে আর আমরা কিছু করতে না পারি। তার পর মামলা করি। এতে আমাদের লাভ হয়তো কিছু হলো না, কিন্তু একটা অন্যায়কে সামনে আনা গেল।"
বামফ্রন্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এখন তৃণমূল মন্ত্রিসভার সদস্য উদয়ন গুহ দাবি করেছেন, অতীতে এ ভাবে নিয়োগ হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বাম আমলের এসব নিয়োগ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের কথাও বলেছিলেন। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের প্রতিক্রিয়া, "নিজেদের রাজত্বে চাকরির নামে লুট করেছে বলে বাম আমলের চিরকুট খুঁজছে!"
আন্দোলনে পথে
সেই আমলের চিরকুট রহস্য থেকে এই আমলে টাকা নিয়ে চাকরি দেয়ার অভিযোগ। হাজার দিনের বেশি পথের ধারে বসে অবস্থান আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। রোদ-ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তারা সংগ্রাম করছেন স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে। এর সঙ্গে চলছে আইনি লড়াই।
এই লড়াইয়ের প্রশংসা করছেন ৪০ বছর ধরে হার-না-মানা প্রবীণরা। প্রশান্তকুমার ঘোষ বলেন, "হাজার দিনের বেশি যারা আন্দোলন করছেন, তাদের কুর্নিশ জানাই। ওদের আন্দোলন সফল হবে।"