আইনসিদ্ধ হলো হিজরারা
১৭ এপ্রিল ২০১৪প্রতিবেশী বাংলাদেশে, পাকিস্তানে, সম্প্রতি নেপালেও চালু হয়েছে সরকারি কাগজপত্রে, ফরমে, পুরুষ বা নারী ছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় ঘোষণা করার সুযোগ৷ ভারতও এবার এই তৃতীয় পরিচয়কে বৈধ ঘোষণা করল৷ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছে, যাঁরা পুরুষ অথবা মহিলা নন, চলতি কথায় যাঁদের হিজড়া বা হিজরা বলা হয়, এবার থেকে তাঁদের সেই পরিচয়টি আইনসিদ্ধ হল৷ সরকারি পাসপোর্ট বা অন্য পরিচয়পত্রে এবার এই নিজস্ব পরিচয়েই তাঁরা পরিচিত হতে পারবেন৷
এই সূত্রে আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্ট যে, যাঁরা জন্মসূত্রে অন্যরকম, তাঁরা তো বটেই, এমনকি যাঁরা নিজস্ব সিদ্ধান্তে লিঙ্গান্তর ঘটিয়েছেন, তাঁদের পরিবর্তিত পরিচয়ও আইনত বৈধ বলে গণ্য করা হবে৷ অর্থাৎ ‘‘আমার জন্মগত লিঙ্গ পরিচয় কী ছিল, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না৷ আমি কী হয়েছি বা হতে চাই, সেটাই বিচার্য'', বললেন শাওন৷ এটা যদিও তাঁর আসল নাম নয়, নেওয়া নাম৷ প্রচলিত অর্থে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়াও নন ২৩ বছরের এই যুবক৷ তিনি আদতে একজন রূপান্তরকামী, যিনি শারীরিক লক্ষণে পুরুষ হয়েও মানসিকতায় মেয়েদের মতো৷
সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পরই অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছেন শাওন৷ বললেন, ‘‘আমার পরিবার বা সমাজ আমাকে কোন পরিচয়ে দেখতে চাইছে, বা কোন লিঙ্গ-পরিচয় আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না৷ আমি কী হতে চাইছি, কোন পরিচয়ে আমি নিজে পরিচিত হতে চাইছি, সেটাই স্বীকৃতি পাবে৷ আধুনিক সভ্য সমাজে এটাই তো হওয়া উচিত! ''
যদিও পরিবর্তনকামী বা রূপান্তরকামী এবং ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন কলকাতায় এবং দেশজুড়ে, তাঁরা সবাই শাওনের মতো খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে পারছেন না৷ বহু বছর ধরে কলকাতা এবং মুম্বইতে সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন পবন ধল৷ তিনি তো পরিষ্কার বলেই দিলেন, সরকার আগে আদালতের এই নির্দেশ কতটা কার্যকর করে, সেটা দেখা যাক৷ সুপ্রিম কোর্ট যদিও রায় ঘোষণার সময়ই কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, হিজড়াদের অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করতে এবং সংরক্ষিত শ্রেণি হিসেবে তাঁদের যা সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য, সেসব দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে৷ অর্থাৎ চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বিশেষ আর্থিক সাহায্য এবং বিবিধ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় আসা৷ কবে সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে শুরু করবে, সে নিয়ে সাধারণ নাগরিক সমাজেরও বেশ সন্দেহ রয়েছে৷
কলকাতার বিভিন্ন ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে আজকাল ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা গাড়ি থেকে হিজরাদের টাকা তুলতে দেখা যায়৷ এটা নতুন হয়েছে, চার-পাঁচ বছর আগেও দেখা যেত না৷ আসলে হিজরা সম্প্রদায়ের রোজগারের একটা বড় রাস্তা ছিল গৃহস্থের বাড়ির শুভ অনুষ্ঠানে, বিশেষ করে শিশুজন্ম হলে দলবেঁধে গিয়ে নাচগান দেখিয়ে টাকা রোজগার৷ আজকাল বহুতল আবাসনের যুগে সেই সুযোগটা প্রায় নেই হয়ে গিয়েছে৷ চাকরি বা অন্য সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ওদের খুশি করবে!
কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া জানা গেল না৷ দু-এক মাস আগেও যে রাস্তার মোড়ে সকাল থেকে রাত ওঁদের দল বেঁধে টাকা তুলতে দেখা যেত, সকালে অফিস যাওয়ার ব্যস্ত সময়ে গিয়ে তাঁদের একজনকেও চোখে পড়লো না৷ মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে খবর নিতে লোকটি জবাব না দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকালো৷ আর তার পাশে তখনও বন্ধ থাকা চিকেন রোলের দোকানের বাচ্চা ছেলেটি বললো, স্থানীয় ভিখারিরা নাকি ওঁদের জবরদস্তি সরিয়ে দিয়েছে৷ ভিখারিদের নাকি রোজগার কমে যাচ্ছিল, তাই!