হঠাৎ বন্যায় অসহায় সিলেট
২৪ জুন ২০২২বিছনাকান্দির পর গত কয়েক বছর ধরে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি ভ্রমণ পিপাসুদের আরেক জনপ্রিয় গন্তব্য৷ ধলাই নদীর বাংলাদেশ উৎসে সাদাপাথর আর জলের খেলায় মেতে অনেক পর্যটক মেঘালয়ের সৌন্দর্য দেখে সীমান্তে দাঁড়িয়ে আফসোসও করেন৷
কিন্তু কজন খবর রাখেন,এবার সিলেটে হঠাৎ বন্যার যে পানি হানা দিয়েছে, তার বড় একটা অংশ মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই অগভীর ধলাই নদ দিয়েই৷ কারণ সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এই ভোলাগঞ্জ থেকে সোজা উত্তরের পাহাড়ে পৃথিবীর সবেচেয়ে বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা চেরাপুঞ্জি৷
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ গত ১৬ জুন এই চেরাপুঞ্জিতে ৯৭ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে৷ যা দেশটির আবহাওয়া বিভাগের কাছে থাকা ১২২ বছরের রেকর্ডে তৃতীয় সর্বোচ্চ৷ তথ্য উপাত্ত বলছে,সর্বোচ্চ ১৫৬ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল ১৯৯৫ সালে৷
এবারের ১৬ জুনের আগে-পরেও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে মেঘালয় ও আসামে৷ সেই পানি নেমে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলকে৷
এরমাঝেই বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: মো: এনামুর রহমান বলেন, সিলেটের এই বন্যা ১২২ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা৷
পরিবেশ বিজ্ঞানী ও পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ,যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ১২২ বছরে এবার তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে৷ সর্বোচ্চ না৷ কিন্তু এবারের বন্যাটা এত তীব্র কেন-সেটা হচ্ছে মূল কথা৷
‘তীব্র বন্যার যত কারণ’
ড. খালেকুজ্জামানের মতে,আগের দুইবারের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হলেও দীর্ঘদিন ধরে ভূমি ব্যবহার বদলে যাওয়ায় এবার বেশি বন্যা হচ্ছে৷
তিনি বলেন,আমাদের হাওরের নদীনালা খালবিলগুলো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ নদীবক্ষ ভরাট হয়ে গেছে৷
‘‘সিলেটের সুরমা নদীর কথাই যদি ধরি, সেটার তলদেশ এখন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে৷ ময়লা আবর্জনা, সিলেটে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তেমনভাবে নেই৷ সিলেট শহরের ছড়া ও নালা-নর্দমা, সুয়ারেজ সিস্টেমও অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে৷ তাই এখন আগের সমপরিমাণ বৃষ্টি হলেও বন্যার তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়৷”
অবশ্য সিলেটে সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী এই আলোচনায় দৃষ্টান্ত হিসাবেও সুরমাকে শুরুতেই সামনে আনতে নারাজ৷
তার মতে, সুরমা-কুশিয়ারার দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী হলেও এই বন্যাকে বুঝতে হলে দৃষ্টি দিতে হবে অন্য নদীগুলোর দিকে৷
সিলেটের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে আসাম থেকে এই দুই নদী বাংলাদেশে এসেছে৷ এর মাঝে সুরমা এসেছে জকিগঞ্জ দিয়ে৷
হাদীর মতে, এই জকিগঞ্জের পর থেকে কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ; সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার,ছাতক,তাহিরপুর; এমনকি নেত্রকোণা পর্যন্ত মেঘনা বেসিন৷ এই বেসিনের প্রায় ৫০টার মত নদী মেঘালয় থেকে এসেছে৷
তার অভিযোগ, মেঘালয় থেকে আসা আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোকে আমরা সেভাবে আমলে নিচ্ছি না৷ সুরমা-কুশিয়ারা নিয়েই আছি৷ অথচ এই নদীগুলোর চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা৷ পাহাড়ে রাতে বৃষ্টি হলে সকাল হতে না হতে হঠাৎ বন্যার পানিতে এখানকার জনপদ-সম্পদ-জীবন সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়৷
তিনি বলেন, আড়াআড়িভাবে সোজা উপর থেকে নিচে পড়ার কারণে এগুলোর পানির বেগ থাকে প্রচণ্ড৷ এ কারণে জানমালের বিশাল ক্ষতি হয়৷
সিলেট অঞ্চলের নদী রক্ষা আন্দোলনের এই সংগঠক বলছেন, এই নদীগুলোর কোনটাই ঠিক অবস্থায় নাই৷ এগুলো দিয়ে প্রচুর পাথর ও বালি আসে৷ মানুষজন এগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে৷ প্রায় নদীই ভরাট হয়ে গেছে৷ অনেকগুলো নদী প্রায় বিলীনের পথে৷
তার মতে, দ্বিতীয় কারণ নদীর প্লাবনভূমি না থাকা৷
তিনি বলেন,ফ্লাশ ফ্লাডের সময় এ সব প্লাবনভূমিতে পানি জমা হতো৷ অনেক নদীর সেই প্লাবন ভূমি এখন আর নেই৷
পানির প্রবাহ নষ্ট করা অবকাঠামো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,এখানের প্রধান সড়ক যদি ধরেন৷ সিলেট-শিলং রোড ১৯২০ সালে ব্রিটিশরা করেছিল৷ উত্তর-পূর্ব অংশের পানি এখানে বাধাগ্রস্ত হয়৷ সিলেট-ভোলাগঞ্জ রোড৷ এটা অনেক উঁচু একটা রোড৷ এবার কোমর সমান পানি এই রাস্তার উপর দিয়ে গেছে৷ছাতক দোয়ারাবাজারে অনেক রোড হচ্ছে৷ নেত্রকোণার অলওয়েদার রোড৷
‘হাওরে বন্যা-বাঁধ-অলওয়েদার সড়কের দায়’
কিশোরগঞ্জের ইটনা,মিঠামইন ও অষ্টগ্রামকে যুক্ত করে নির্মিত হয়েছে অলওয়েদার সড়ক৷ এর নির্মাণে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি বলে মনে করেন লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান৷
নির্মাণের আগে এটির অন্তত ৩০ ভাগ এলিভেটেড করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু তার সেই পরামর্শে কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ৷ তবে সম্প্রতি হাওরের সব সড়ক এলিভেটেড করতে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে নিজের সেই অবস্থানের বিজয় হিসাবেই দেখছেন তিনি৷
সিলেটের বন্যায় এই অলওয়েদার সড়কের দায় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,সিলেট ও সুনামগঞ্জ থেকে অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনের সড়ক অনেক ভাটিতে৷ তাই এই বন্যার সাথে এই সড়কের খুব একটা সম্পর্ক নেই৷
‘‘তবে বন্যা যখন আস্তে আস্তে কিশোরগঞ্জে নেমে আসবে,তখন এই সড়ক স্বাভাবিক পানি চলাচলে কিছুটা বাধা দিতে পারে৷ তখন ওই রাস্তার একদিকে বন্যার তীব্রতা কিছুটা বেশি হতে পারে৷”
এখনকার বন্যায় ভূমিকা না থাকলেও হাওরের পরিবেশে এই সড়কের দায় আছে বলে মনে করেন তিনি৷
এটা বোঝাতে তিনি হাওর বোঝার উপর গুরুত্ব দেন৷
তার মতে,বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রায় ৩৭৩টা হাওর রয়েছে৷ বর্ষাকালে এগুলো একটার সাথ আরেকটা সংযুক্ত হয়ে মিঠাপানির সাগরে পরিণত হয়৷ সাগর থেকেই অপভ্রংশ হাওর৷এটা প্রকৃতির অন্যন্য সাধারণ একটা উপাদান৷
‘‘এটা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে৷ এর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে,পানির অবাধ চলাচল৷ মাছের অবাধ চলাচল৷ কৃষক-মাঝি-জেলেরাও যেন বর্ষাকালে হাওরের যে কোন জায়গায় যাতায়াত করতে পারে৷”
‘‘এখন আপনি যদি হঠাৎ করে একটা অলওয়েদার রাস্তা করে ফেলেন৷ তাহলেতো সেই বৈশিষ্ট্যটা অক্ষুন্ন থাকছে না৷ এটাকে নষ্ট করে ফেলছেন৷ কারণ পানির অবাধ চলাচল থাকছে না৷ মাছের অবাধ বিচরণক্ষেত্র থাকছে না৷ মাঝি-জেলে যেতে পারছে না৷
"কিন্তু এখানে ৩০-৩৫ শতাংশ উড়াল সেতু করা হলে পানির অবাধ চলাচল থাকতো৷”
তিনি বলেন,এই সড়কের পশ্চিম পাশে ধনু,পূর্বপাশে কালনী নদী৷ একটা নদীতে বেশি পানি হলে সেটা গড়িয়ে অন্য নদীতে যেতে পারতো৷
এক প্রশ্নের জবাবে ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে কথা বলেন তিনি৷ তার মতে,এ সব বাঁধ দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ফসল রক্ষা হয় না৷ এটা বরং মানুষকে ফলস সেন্স অব সিকিউরিটি দেয় যে,এগুলো আমাদেরকে রক্ষা করবে৷
খালেকুজ্জামান বলেন, এই বাঁধের কারণে ভূউপরিউস্থ পানি,বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে গতি কিছুটা স্লথ হয়ে পড়ে৷ তাতে করে পানিটা সরতে গিয়ে সময় লাগে৷ বন্যাটা আরো বেশি প্রলম্বিত হয়৷
ফসল রক্ষা বাঁধ না করলে চলবে কী করে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,না করে করতেই পারলে ভালো৷ আমি নিজে কৃষি বিজ্ঞানী না৷ তবে হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা নিশ্চয়ই ফসল রক্ষা বাঁধের উপর নির্ভর করতেন না৷ করলেও তখন বাঁধগুলো ছিল ভিন্ন৷ যেমন,তখন বলা হতো অষ্টমাসি বাঁধ৷ আট মাস ধরে বাঁধ থাকবে৷ তারপর সেটাকে সরিয়ে দেয়া হবে৷ প্রকৃতির সাথে মিল রেখে বাঁধ৷
এই অষ্টমাসি বাঁধকে মাথায় রেখে নতুন কিছু করা যেতে পারে বলে মত তার৷
তিনি বলেন,হাওর অঞ্চলের সব পানিই নিষ্কাসিত হয় ভৈরব ব্রিজের নিচ দিয়ে৷ সেখানে আগে একটা ব্রিজ ছিল৷ এখন আরো দুইটা ব্রিজ হয়েছে৷ ভৈরবের বাঁধের নিচে একটা বটল নেক তৈরি হয়েছে৷ আগে বলেছি,ভাটিতে নদীর প্রস্থ বাড়তে হয়৷
‘‘কিন্তু এখানে উল্টো হয়েছে৷সেখানে পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে৷ সংকুচিত হয়ে গেছে৷ পিলারের কারণে পলি জমে ধারণ ক্ষমতা আরো কমে গেছে৷ তাই কেবল এই বন্যা নয়৷ অন্যান্য বন্যায়ও পানি সরতে সময় বেশি নেয়৷ এ কারণে হাওরের বন্যা আরো বেশি জলাবদ্ধতা তৈরি করে,আরো বেশি ক্ষতির কারণ হয়৷”
হঠাৎ করে প্রকল্প গ্রহণের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, অলওয়েদার সড়ক কিন্তু ডেল্টা প্লানেও নেই৷ হাওর মাস্টার প্লানেও নেই৷
বন্যার দুর্দশা ও ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
এবারের হঠাৎ বন্যায় থমকে যায় সিলেট অঞ্চল৷ কেবল খাদ্য-পানি-আর আশ্রয়ের সংকটই ছিল না৷ বিদ্যুৎ চলে যায়, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়৷ চার্জের কারণেও অনেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেননি৷
সিলেটের সাংবাদিক দ্বোহা চৌধুরী এই বন্যা খুব কাছে থেকে কাভার করছেন৷ বন্যার শুরু থেকেই সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলের নানা এলাকা তিনি চষে বেড়িয়েছেন৷ ‘৮০০ টাকার নৌকা ভাড়া এখন ৫০ হাজার'-শিরোনামে তার একটি প্রতিবেদন ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷
এই প্রতিবেদনের পেছনের গল্প প্রসঙ্গে গিয়ে তিনি বলেন,শুরুতেই ডুবে যাওয়া কোম্পানিগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় যেতে সিলেটের সালুটিকর থেকে বড় নৌকা বা ট্রলার যায়৷
‘‘আগের দিনই (১৭ জুন)সিলেটের লোকাল গ্রুপগুলোতে চোখে পড়েছে যে, অনেকে বলেছে, নৌকা ভাড়া অনেক বেশি৷ সেই কারণে তারা ত্রাণ নিয়ে যেতে পারছে না৷”
‘‘পরদিন গিয়েও দেখলাম,নৌকা ভাড়াটা বেশি চাচ্ছে৷"অনেক বেশি টাকা দিয়েও অনেকে নৌকা পাচ্ছিলেন না৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে৷ তখন ওখানে গিয়ে এই সিনারিটা চোখে পড়লো৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,প্রথম দুই তিন দিনে এটা কমন হয়েই গিয়েছিল৷ এই দুই উপজেলার অনেক মানুষ সিলেট শহরে চাকরি করেন,সিলেট শহরে থাকেন৷ ফ্যামিলি ওখানে থাকে৷ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যান, আবার শহরে চলে আসেন৷
‘‘ওইদিকে পানি রাতারাতি বাড়ছে৷ তাই আগে থেকে ওইদিকে যাওয়া বা তাদেরকে নিয়ে আসার সুযোগ হয় নাই৷ নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে৷ যোগাযোগও করতে পারছেন না৷ এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছে যে, সব মানুষ ওখান থেকে রওনা দিতে চাচ্ছে৷ এটাও একটা কারণ,এর ফলে সেখানকার মাঝিরা তৎক্ষণাত একটা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেছে৷”
‘‘নিয়মিত মাঝিদের পাশাপাশি বালু ও পাথর পরিবহনের ট্রলারগুলোও সালুটিকর ঘাটে এসে পরিবহন করছিল৷ তারাও অনেক বেশি চার্জ করছিল৷কারণ ডিমান্ড ছিল টু-মাচ৷”
তবে এখন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷
তিনি বলেন,দুইদিন আগেও (২০ জুন)ত্রাণের একটি নৌকাকে ভাড়া দিতে হয়েছে ১০ হাজার টাকা৷ এখন (২২জুন)অনেকে কমেছে৷ তবে কিছু কিছু জায়গায় অনেক কম টাকায় বা বিনামূল্যেও কেউ কেউ নৌকার সাপোর্ট দিচ্ছেন৷ কেউ কেউ তেল খরচেও সার্ভিস দিচ্ছে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,এখন পর্যন্ত ত্রাণ কার্যক্রম সন্তোষজনক না৷ আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জের কথা বলছি৷ গতকাল দূর-দূরান্তের গ্রামের খবরও পাচ্ছি৷ ত্রাণ কার্যক্রম সন্তোষজনক না৷
‘‘আজকেও একটা রিপোর্ট করেছি,সিলেটে কী পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে,সেটা পানিবন্দি মানুষের তুলনায় কতটুকু৷ আমাদের হিসাব বলছে,পার হেড ৪৪০ গ্রাম চাল সরকার বরাদ্দ দিয়েছে৷ বণ্টনের কথা যদি বলি,অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে বুধবারও ত্রাণ পৌঁছায়নি৷”
‘‘বিশেষ করে,সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ,গোয়াইনঘাট,সুনামগঞ্জের ছাতক,দোয়ারাবাজার বিস্মম্ভরপুর-এ সব এলাকার রিমোট জায়গাগুলোতে সরকারি ত্রাণ এখনো (২২জুন) পৌঁছায় নাই৷”
সিলেটে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেও সুনামগঞ্জে হাওরাঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্রেরও সংকট রয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷
তবে সবচেয়ে বেশি সংকট তিনি দেখছেন সমন্বয়ে৷ শহরের আশেপাশে অনেক এলাকায় বারবার ত্রাণ বিতরণ হলেও অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে কেউ যাচ্ছে না৷
তার মতে,মুখে জেলা প্রশাসন যদিও সমন্বয়ের কথা বলছেন৷ কিন্তু ত্রাণ বিতরণ করতে কোন এলাকায় যেতে হবে, সেটা যে কেউ যে কোন সময় জানার কোন ব্যবস্থাপনা তার চোখে পড়েনি৷
সিলেটের গোয়াইনঘাট,জাফলং এবং জৈন্দাপুর এলাকায় ত্রাণ বিতরণে ছিলেন ফ্যাক্ট চেকার আমির শাকির৷
বুধবার তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন,তার ঘুরে দেখা এলাকায় পানি পাঁচ ফিটের মত কমে গেছে৷ খাটের উপরে যাদের পানি উঠেছিল,তাদের উঠান থেকেও পানি নেমে গেছে৷
পথে অনেক বাড়ি একেবারে ভেঙে পড়েছে বলেও দেখেছেন তিনি৷ আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন বাড়িও তার চোখে পড়েছে৷ ভেঙে পড়া বাড়ির সংখ্যা ১-২ শতাংশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ৩০ শতাংশের মত হতে পারে বলে তার ধারণা৷
বন্যার পূর্বাভাস কতটা সম্ভব?
বাংলাদেশের বন্যার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য রয়েছে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান৷ এর নাম ‘বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র'৷
এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো.আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বন্যা হওয়ার আগে আমরা বুঝতে পারি এবং সেই অনুযায়ী আমরা পূর্বাভাসও দেই৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আমাদের পরে সরকারের প্রায় ১৭টা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর আছে, যারা এই বন্যা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত৷সবারই নিজেদের অবস্থান থেকে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে৷
‘‘কেউ বার্তাটা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়৷ কেউ রেসকিউ অপারেশনের প্রস্তুতি নেয়৷ কেউ খাদ্য সামগ্রীর বিষয়ে প্রিপারেশন নেয়৷ কেউ হয়ত লাইভ স্টকের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়৷ বিভিন্ন সংস্থার কাজ থাকে এখানে৷”
‘‘আমাদের পূর্বাভাসে থাকে যে,উজানে ভারি বৃষ্টিপাত হবে৷ নদনদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে৷ কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা হয়ত মেয়াদটা বলি, এই কয়দিনের বন্যা হবে৷”
‘‘তার ভিত্তিতে প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে,কে কোন এলাকায় আছে, কার জন্য কতটা বিপদ আসবে৷ আমরা প্রতিটা পয়েন্টের জন্য আলাদা আলাদাভাবে বলে দিতে পারবো না যে, এখানে সাধারণ বন্যা হবে, ওখানে তীব্র বন্যা হবে৷”
চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিটা আঁচ করতে পেরেছিলেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,আমরা কেন সবারই একটা সাধারণ ধারণা থাকা উচিত,এ বছর যেহেতু এপ্রিল মাসে তীব্র বৃষ্টি হলো৷ এরপর আবার মে মাসে বৃষ্টি হলো৷ সেটাও তীব্র হলো এবং জুন মাসের বৃষ্টির আগে যখন আমরা ওয়ার্নিং দিলাম৷
‘‘তখনও সাধারণ মানুষ যদি এটা বুঝতে না পারে৷ প্রশাসন বা প্রস্তুতি নেয়ার জায়গা যাদের আছে, তারা যদি বুঝতে না পারে৷ সেক্ষেত্রে এরচেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নাই৷”
‘‘আমরা আমাদের ওয়ার্নিং বার্তাটা তৈরি হওয়া মাত্র আমরা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি৷ তারা যে পাচ্ছে,সেটাও আমরা নিশ্চিত করি৷ এরপরের পদক্ষেপ তাদের,আমাদের না৷”
এক প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের পরিচালক অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন,আমাদের পূর্বাভাস কেন্দ্র মুনসুন ফ্লাডের জন্য পূর্বাভাস দেয়ার কাজ মোটামুটি দক্ষতার সাথেই করেন৷
তিনি বলেন,আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি দেশের বাইরে থেকে আসে৷ সেই সব নদীর তথ্য-উপাত্তও আমাদের কাছে অত একুরেটলি থাকে না৷ এটা দুই দেশের বা একাধিক দেশের যারা বেসিন শেয়ার করছে,তাদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান বাড়লে বেসিনওয়াইজ ফ্লাড ফোরকাস্টিং করলে সেটা অনেক একুরেটলি করা সম্ভব৷
তিনি বলেন,ইউরোপে অনেক দেশে এগুলো একইসাথে করে থাকে৷ আমাদের আরো সঠিকভাবে ফোরকাস্ট করতে হলে সেটা যৌথভাবে করা সম্ভব৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,এই জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করা নাই৷ অনেক এলাকায় আমাদের বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র নাই৷ একটা বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র হওয়ার যে ক্রাইটেরিয়া যে,তার রাস্তা থাকতে হবে,টয়লেটসহ অন্যান্য সুবিধা থাকতে হবে৷ আমাদের এই জায়গায়ও একটু কাজ করা দরকার৷ কারণ বন্যা এখন যেভাবে আসছে,আমাদের বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো দরকার৷
‘‘বিশেষ করে গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নেয়ার মত জায়গা থাকে না৷ উত্তরবঙ্গের দিকে কিছু আশয়কেন্দ্র আছে৷ যেহেতু প্রতি বছর বন্যা হয়৷ বিশেষ করে চরে৷ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্র কম৷”
‘‘স্বেচ্ছাসেবী আমাদের কম৷ এটার এটাও হতে পারে,এটা অতটা ডেডলি ফর্মে আসে না৷ কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দুর্যোগ মোকাবেলায় এখানেও আমাদের স্বেচ্ছাসেবী দরকার৷”
তিনি বলেন,ইন্ডিয়া মেটিওরোলোজিকাল ডিপার্টমেন্ট গত ৮জুন পুর্বাভাসে জানিয়েছিল যে, ১৬ জুন উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে ভারী বৃষ্টিপাত হবে৷ অবশ্য ১ হাজার মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টির পূর্বাভাস এখনো সম্ভব নয়৷
ভবিষ্যতে যা করতে হবে
অধ্যাপক খালেকুজ্জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে বন্যা আরো বাড়বে৷ এমনকি অকাল বন্যা হবে৷ সেগুলোও আমি আমার গবেষণায় পেয়েছি৷
‘‘বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ইদানিং৷ আগে মে জুনে বেশি বৃষ্টিপাত হতো৷ এখন একটু আগে হয়৷ এ জন্য ফসলে কিছু পরিবর্তন আনতে হতে পারে৷ বন্যা সহনশীল ফসল করা যায়, সেটা ভাবতে হবে৷”
তিনি বলেন, সিলেট শহর অনেক উঁচু৷ সিলেটে গেলে দেখবেন, নদীগুলো অনেক নিচু৷ কিন্তু সিলেটে গেলে দেখবেন, নদীগুলোর বেহাল দশা৷ সুনামগঞ্জেও তাই৷ বন্যা এতটা ব্যাপকভাবে হবে, সেটার জন্য মানুষ প্রস্তুত ছিল না৷
তিনি বলেন,আমাদের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো বুঝে নিয়ে প্রকৃতির সাথে খাপখাইয়ে কীভাবে বাস করা যায়, সেই লক্ষ্যে আমাদেরকে অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে৷ অনেক বেশি কার্যকলাপ করতে হবে৷ অনেক বেশি গবেষণা করতে হবে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকৃতিকে বুঝতে পারার মত তেমন কোন প্রকল্প ডেল্টা প্লানেও নেই৷ বদ্বীপের গঠন প্রক্রিয়া জানার জন্যই একটা প্রকল্প হতে পারতো৷
তিনি বলেন, মেঘালয়ে অনেক পাহাড় কাটা হয়,অনেক মাইনিং হয়, অনেক বন উজাড় করা হয়৷ সেখান থেকেই মূলত পলি ও পাথর সরে আসে৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও যখন নির্মাণ কাজ করা হয়, পাহাড়-টিলা কাটা হয়, কৃষি কাজ করা হয়-সেগুলোও বাড়তি পলির জন্ম দেয়৷
‘‘এই পলিতে কিছুটা বালু আছে৷ কিছুটা কাদামাটি আছে৷ বালুকে নির্মাণে বাণিজ্যিক কাজে লাগানো যেতে পারে৷ এ ব্যাপারে স্টাডি হওয়া প্রয়োজন৷ পলি খনন,পলি সরানো এবং পলিটাকে কাজে লাগানো৷ এটাকে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে৷”
‘‘পলি সরিয়ে আমাদের নদীর ধারণ ক্ষমতাকে আগের চেয়েও বাড়াতে হবে৷ কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তি বৃষ্টি তৈরি হয়েছে৷’’
‘‘সেই বাড়তি বৃষ্টিকে আমাদের একোমোডেট করতে হবে৷ চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে৷ এ জন্য আমাদের নদী-নালা খাল-বিলের ধারণ ক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে৷’’
আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, সিলেট বিভাগে ১৬টি স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদী আছে৷ এর বাইরে আরো প্রায় অর্ধ শতক নদী আছে, এগুলো দুই দেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে৷
‘‘নদীর ভাগাভাগির বিষয়টা,দায় যেহেতু বাংলাদেশের বেশি-সুতরাং বাংলাদেশকে একটু অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে পারস্পরিক তথ্য বিনিময়,বিশেষ করে ওখানকার আবহাওয়ার পূর্বাভাসটা আগাম যেন আমরা সিলেট থেকে জানতে পারি৷ তাহলে এখানকার মানুষরা দ্রুত সতর্ক হতে পারবে৷ জানমালের ক্ষতি কম হবে৷’’