হজ: বাণিজ্য নৈতিকতা আর সরকারের দায়
২ আগস্ট ২০১৯বাংলাদেশের মানুষ তিনটি ক্ষেত্রে অর্থব্যয় নিয়ে চিন্তা করে না, মরিয়া থাকে৷ বিয়ে, চিকিৎসা এবং বিদেশগমন৷ এ সময় ধারদেনা করে হলেও টাকা পয়সা জোগাড় করে৷ আর হজ তো নিছক বিদেশগমনই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ধর্মীয় আবেগ ও বাধ্যবাধকতা৷ হজে যাবে বলে- অনেকে বছরের পর বছর টাকা পয়সা জমিয়ে রাখেন৷
অনেক মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীকেও দেখেছি অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা হাতে পেলে প্রথমেই ভাবেন- স্বামী স্ত্রী দু'জনে মিলে হজে যাওয়ার কথা৷ পুরো পরিবারে তা নিয়ে সে কি উৎসাহ! কিন্তু সেই আনন্দ ধীরে ধীরে উৎকণ্ঠায় পরিণত হতে থাকে, হজযাত্রার দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে৷ এদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর কত লোক হজে যায়, তারচেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ২০ গুণ মানুষ হজে যায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়৷ এই বেসরকারি ব্যবস্থাপনা বিষয়টি কিন্তু বড় অদ্ভুত৷ হজ এজেন্সি বলতে সরকারের নিবন্ধিত যারা আছে, তারা কিন্তু সরাসরি হজযাত্রীদের সঙ্গে শুরুতে যোগাযোগ করে না৷ আদম ব্যবসায়ীরা যেভাবে দালালের মাধ্যমে শ্রমিক সংগ্রহ করে, অনেকটা তেমনি এজেন্ট সাবএজেন্টের মাধ্যমে এরা সংগ্রহ করে হজযাত্রীদের৷ সিংহভাগ হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে এই গ্যাপটা প্রকট হয়ে দেখা দেয় একেবারে যাত্রার আগ মুহূর্তে৷ এজেন্সিগুলো হঠাৎ করে বলে বসে, এজেন্ট বা সাবএজেন্টরা নাকি তাদেরকে সব টাকা দেয়নি, তাই আরও আরও অর্থ দিতে হবে৷ প্রতিবছরই এসব নিয়ে হইচই হয়, সকল প্রস্তুতি সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে অনেকের হজযাত্রা বাতিল হয়ে যায়৷ অনিয়ম করার কারণে সরকারও মাঝমধ্যে কিছু কিছু এজেন্সিকে কালো তালিকাভূক্ত করে৷ এতে অবশ্য কাজের কাজ তেমন কিছু হয় না৷ কারণ পরের বছর দেখা যায়, ওই একই মালিক অন্য নামে নতুন এক এজেন্সি নিয়ে ঠিকই ব্যবসায় করছে৷
আমার বিবেচনায় হজের সকল অনিয়মের দায় প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকারের ওপর যেয়ে পড়৷ কিছু অনিয়ম সরকার হতে দেয়, কিছু সে নিজে করে৷ যেমন ধরা যাক বিমানভাড়ার কথা৷ এমনিতে সৌদি আরবে বিমানের ভাড়া ৪৫ থেকে ৫২ হাজার টাকার মধ্যে ওঠা নামা করে৷ কিন্তু আপনি যখন হজ করতে যাবেন- দিতে হবে প্রায় তিনগুন৷ সরকার অবশ্য বলে থাকে, হজের জন্য তারা ডেডিকেটেড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে থাকে৷ এই ফ্লাইটগুলো যাওয়ার সময় ভরে গেলেও সৌদি আরব থেকে ফেরার সময় নাকি খালি আসে, আবার হজ শেষে ফেরার সময় ভরে এলেও আনতে যাওয়ার সময় খালি যায়৷ এ অজুহাতটিকে যদি সত্য বলে ধরেও নিই, তবু কিন্তু ভাড়া দ্বিগুণের বেশি হওয়ার কথা নয়৷ ৪৫ হাজারের ভাড়া ১ লাখ ২৮ হাজার হয় কি করে? বাংলাদেশ বিমানের কথা বাদ দিন, সৌদি এয়ারলাইনসেও এই এরকম আকাশচুম্বি ভাড়া হয় আদায় করা হয়৷ কিন্তু সৌদি এয়ারলাইনসের ফ্লাইটগুলো তো আর ডেডিকেটেড হজ ফ্লাইট নয়৷ তারা একই ফ্লাইটে সাধারণ যাত্রীও নেয়৷ ফলে দেখা যায়, পাশাপাশি সিটে বসে সাধারণ যাত্রী যাচ্ছে ৪৫ হাজার টাকায়, হজে যাওয়ার অপরাধে (?) অন্যজনকে গুণতে হচ্ছে প্রায় তিনগুণ ভাড়া৷ এমন বৈষম্যকে কি অন্যায় বলা যাবে না? এক হিসাবে দেখা গেছে, এক হজ মৌসুমেই এভাবে সৌদি এয়ারলাইনস বাংলাদেশী হজযাত্রীদের কাছ থেকে সাড়ে চারশ' কোটি টাকারও বেশি ভাড়া নিয়ে যাচ্ছে৷ এমন অন্যায়ের সুযোগটা কে করে দিচ্ছে?
বিমানের পক্ষ থেকে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়৷ তারা বলে- সারা বছর তারা যে লোকসান করে, হজের সময় সেটা পুষিয়ে নেয়৷ বিমানের আয়-ব্যয়ের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়৷ তাহলে বিমানের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির দায় মিটাতে হবে নিরীহ ধর্মপ্রাণ হজযাত্রীদের? কোথায় আমরা আশা করবো- হজের সময় সরকার আরও সাহায্য করবে, বিমানের ভাড়া কমিয়ে দেবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাবসিডি দেবে; তা নয়, হচ্ছে উল্টোটা!
তাহলে কি নিজেদের অপচয়ের অর্থ জোগাতেই মন্ত্রণালয়গুলো এমন করছে? কেবল বিমানের লোকসানের কথাই বা কেন বলি, অপচয় কি খোদ ধর্ম মন্ত্রণালয়ও করছে না৷ এবারও তারা প্রায় সাড়ে আটশ' লোককে রাষ্ট্রীয় খরচে হজে পাঠাচ্ছে৷ নানা ক্যাটাগরিতে এই লোকগুলোকে পাঠানো হলেও এদের মধ্যে একটা মিল কিন্তু রয়েছে, সেটা হচ্ছে- এরা সবাই রাজনৈতিকভাবে সরকার ঘনিষ্ঠ৷ প্রশাসনিক, কারিগরি, চিকিৎসা- এমন কিছু আপাত প্রয়োজনীয় ক্যাটাগরির বাইরে আজব কিছু ক্যাটাগরিও রয়েছে৷ যেমন, ২০৭ জনের চিকিৎসক দলে ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট এরা থাকার পরও ১১৮ জনের একটি চিকিৎসা সহায়ক দল যাচ্ছে৷ মালি, ক্লিনার, ড্রাইভার, কেরানি, এমপিদের গানম্যানসহ বিচিত্র ধরনের লোক রয়েছে এই দলে৷ চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই লোকগুলো শেষ পর্যন্ত কি করবেন, অথবা করতে পারবেন- বলা কঠিন৷
আবার রয়েছে ওলামা মাশায়েখদের একটি দল৷ এই টিমের সদস্য সংখ্যা ৫৭ জন৷ এদেরকে কিভাবে নির্বাচন করা হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এরই মধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়ে গেছে৷ বলা হচ্ছে- একটি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই কেবল এই টিমে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে৷
আর একটি বিশাল দল হচ্ছে "ধর্মপ্রাণ মুসলমান”দের দল৷ এদের সংখ্যা ৩০৯ জন! রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারি, সাংবাদিকসহ অনেকেই রয়েছে এখানে৷ এদের নির্বাচন করা হয়েছে কোন মাপকাঠিতে? কেউ জানেন না৷ সাংবাদিকদের তালিকার দিকে তাকালে দেখা যায়- এদের সিংহভাগই সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হিসাবে৷ সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হলে যে "ধর্মপ্রাণ মুসলমান” হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া যায়, সেটা এই তালিকা না দেখলে টের পাওয়া হয়তো কঠিন হতো৷
এতকিছুর বাইরে যে তালিকাটি নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে, সেটা হচ্ছে দশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির তালিকা৷ এই তালিকায় রয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, ধর্মপ্রতিমন্ত্রীসহ তিনজন প্রতিমন্ত্রী, তিনজন এমপি, স্বাস্থ্য ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক৷ এই দশজনের কাজ হবে সার্বিক তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনা৷ যেখানে তত্ত্বাবধানের জন্য প্রশাসনিক দল রয়েছে, দিক নির্দেশনার জন্য ওলামা মাশায়েখ দল রয়েছে, সেখানে এরা বাড়তি কি কাজ করবেন বলা মুশকিল৷ এদের জন্য আবার একটা বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে, এরা প্রত্যেকেই তাদের স্ত্রী সন্তানদের মধ্যে থেকে তিনজনকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবেন৷
যে প্রশ্নগুলো বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে, তা হলো সরকারি তথা জনগণের অর্থে এত বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে হজ কাফেলায় পাঠানোর আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি না৷ না হলে বলতে হবে, এটা একধরনের অপচয়৷ নাকি বিশেষ বিশেষ মানুষ বা শ্রেণীকে দেয়া উৎকোচ?
জনগণের অর্থ সরকারের কাছে থাকে আমানত হিসাবে৷ এই আমানতের প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব দেয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব৷ সরকার কি এত লোককে হজে পাঠানোর সময় তার সেই দায়িত্বটির কথা মনে রেখেছে?
পাশাপাশি আরও যে প্রশ্নটি উচ্চারিত হচ্ছে- সেটা একেবারেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে৷ বলা হয়েছে- সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলমানের উপরই হজ ফরজ৷ অর্থাৎ যাদের অর্থনৈতিক সামার্থ্য রয়েছে, তারা নিজ অর্থব্যয়ে জীবনে একবারের জন্য হলেও হজ পালন করবেন৷ যাদের সামর্থ্য নেই, তাদেরকে যদি সরকার হজ পালন করতে পাঠান তাহলে হয়তো তেমন আপত্তির কিছু থাকতো না৷ কিন্তু এই লম্বা তালিকায় যাদের যাদের নাম দেখা যাচ্ছে- তাদের মধ্যে হজ পালনে অসামর্থ্যবান কয়জন আছেন? ওনারা কি খুবই গরীব? নাকি তারা মানসিকভাবে গরীব? না হলে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া সত্ত্বেও সরকারি টাকায় হজে যেতে এত আগ্রহ অনুভব করছেন কেন? এভাবে যেতে পেরে তাদের নৈতিকতাবোধ কি তাদেরে বিবেককে পীড়িত করছে না?
তবে এবিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেশ একটা যুক্তি দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন- এই ধারা অনেক বছর ধরে চলে আসছে, এটা নতুন কিছু নয়৷ তাছাড়া এনিয়ে কেউ আপত্তি তো তুলছে না৷ তাহলে অসুবিধা কোথায়?
মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর এমন কথায় মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে৷ একটা অনিয়ম অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে, সেটি নিয়ে কেউ আপত্তি না তুললেই সেটি বৈধ নিয়মে পরিণত হয়? তাহলে নীতি আর নৈতিকতা বলে কি কিছু থাকতে নেই? ওনার নিজের বিবেক কি বলে? আর আপত্তির কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো- প্রতিবছর এনিয়ে আপত্তি ওঠে, প্রশ্ন ওঠে৷ কিন্তু ওনারা পাত্তা দেন না৷