যদিও ৫০ বছরের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নারীদের চলার পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না৷
হাজারো বাঁধা নিষেধের দেয়াল ভেঙে, ঝড় ঝঞ্ঝা পাড়ি দিয়ে, শাসন বারণের পাহাড় ডিঙিয়ে, অপমান ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিপীড়ণ নির্যাতনকে তুচ্ছ করে নারীরা অদম্য শক্তিতে বেরিয়ে এসেছে৷ ৫০ বছর আগের সেই প্রান্তিক- অক্ষম- অবলা- অশিক্ষিত- পরনির্ভরশীল- লাজুক এবং অন্ধকারে ডুবে থাকা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তকমা ছুঁড়ে ফেলে অনেকাংশেই নারী নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে মূলধারায়৷ আপন শক্তিতে বলীয়ান নারী নিজে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে নতুন ভাবে নির্মাণ করেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রমাণ রেখেছে নিজের সক্ষমতার৷
এখন আমরা খালি চোখেই বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাই৷ অবশ্যই এই পরিবর্তন কারো একার অর্জন নয়৷ বরং ব্যক্তিগত, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ সমূহের মিলিত প্রচেষ্টাতেই এই অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে৷
গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে নারীর অবস্থান প্রসঙ্গে খুব জনপ্রিয় একটা কথা প্রচলিত আছে৷ সেটা হচ্ছে, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী- সেই দেশে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই৷ রাষ্ট্রের শীর্ষ পদগুলো নারীর দখলে- এমন কথা শুনতেও হয়তো ভালই লাগে৷ কিন্তু এটা যে সত্যের পুরোটা নয় তা অনেকেই জানেন৷ কারণ, এই সুখসত্যের অপর পিঠে কিছু অপ্রিয় সত্যও রয়ে গেছে৷ নারীর ক্ষমতায়ন শুধু গুটি কয়েকজনের শীর্ষ পদে আসীন থাকাকে বোঝায় না৷ ক্ষমতায়ন আসলে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া৷ যে প্রক্রিয়ায় নারী তার নিজের জীবনের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা নির্বাচনসহ সবক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়৷ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সমঅধিকারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারে৷
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে নারীর জীবন নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এখনো এই দুহাজার একুশ সালেও অত্যন্ত সীমিত৷ অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন নারীও এখনো চাইলেই তার মতামত প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান না, বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন৷ এই বাধা অতিক্রম করেই বাংলাদেশের নারীদের এগোতে হয়েছে৷
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারী নেতাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে ৭ম অবস্থানে আছে৷ বর্ধিত সংখ্যক নারী কর্মীবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী এবং তারা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছে৷ তৈরি পোশাককর্মীদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ (ডেইলি ষ্টার , সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১)
এটা ঠিক যে, পরিসংখ্যানের চিত্র দেখলে বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে৷ জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে৷ বর্তমানে সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচিত ২২ জনসহ ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন৷ স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিও আছেন ১২ হাজার জনের মতো৷
অবশ্য সার্বিকভাবে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ সুখকর নয়৷ শ্রেণি ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এদেশর নারীরা আজো রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণ থেকে অনেক দূরে৷ এটা স্বীকৃত যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া নারীর পূর্ণ বিকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ সমাজ ও রাজনীতিতে নারীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে, কথা বলার অধিকার পেতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষ দুজনেরই নাগরিক হিসেবে সমঅধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি৷ সংখ্যাগত বিচারে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের অনুপাত এখন সমান সমান৷ নারীকে অধস্তন হিসেবে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পুরনো কৌশল বা মানসিকতা পোষণ করার কোনো সুযোগ আর নেই৷
ক্ষমতায়নের অন্যান্য ক্ষেত্র, যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগেও নারীর পদচারণা গত ৫০ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে৷ সহস্রাধিক নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ নারীরা বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ার পারসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন৷ নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এই নারীরা তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন৷ সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন৷
কিন্তু এসবই মুদ্রার এক পিঠের ছবি৷ মুদ্রার অপর পিঠে রয়েছে নারীর প্রতি চরম অবহেলা, সীমাহীন বৈষম্য ও ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র৷ সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে এখনো দেশে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি৷ সমাজে এখনো নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান৷ নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও ক্রমবর্ধমান৷ এখনো পথে ঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, গৃহে নারীরা নিরাপত্তাহীন৷ সমাজে বহুযুগের পুরনো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এখনো প্রবল দাপটে রাজত্ব করে চলছে৷ যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ এবং যৌন হয়রানির মত ঘটনা বাড়ছে৷ নারীর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা না থাকায়, নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যা-শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়ার প্রবণতাও বাড়ছে৷ এদিকে, বাল্যবিবাহের ফলে নারীর শিক্ষা-জীবন ব্যাহত হয়েছে৷ কর্মক্ষেত্রে তার অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে৷ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে৷ মাতৃ-মৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের একটি কঠিন দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে৷ আর এসবের প্রভাব সরাসরি পড়ছে নারীর উপর৷
নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে নারী পুরুষ সমতা অর্জনের বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্খিত মাত্রায় নারীর ক্ষমতায়ন অর্জন সম্ভব নয়৷ শারীরিক মানসিক নির্যাতন নিপীড়ণ নারীকে সামনে এগুতে বাধা দেয়, ক্ষমতায়নে বিঘ্ন ঘটায়৷
নারীর ক্ষমতায়ন শুধু নারীর জন্য দরকার নয়, একটা সমৃদ্ধ সুখী সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দরকার৷ দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে কখনোই সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ এজন্য নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যে কোন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনায় নারীর যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে৷
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের নারীদের ক্ষমতায়নে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণের কারণে প্রান্তিক নারীরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারছে না৷ সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়ায় কার্যকর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা পালনও বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে৷ নারীকে পুরুষের তুলনায় দুর্বল ও হীন করে দেখার মানসিকতা বদলায়নি৷ সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসেনি৷ ফলে এখনো আমরা অনেককেই দেখতে পাই অবলীলায় নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর ও অশালীন বক্তব্য দিতে দ্বিধা করছেন না৷
বাংলাদেশের নারীর বঞ্চনারও যেন শেষ নেই৷ সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে নারীরা উপেক্ষিত৷ নারীর গৃহশ্রমের কোনো মূল্যায়ন নেই৷ নারী পুরুষ সমতার বিষয়টিও এখনো নিশ্চিত করা যায় নি৷ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০' অনুযায়ী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নারী সমতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছে৷ এই জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম৷ এ সূচকে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ এগুলো হচ্ছে: (ক) অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ এবং সুযোগ; (খ) শিক্ষাগত অর্জন; (গ) স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকা; (ঘ) রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন৷
সমাজের সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জন করতে হলে এই চারটি সূচকের সবগুলির দিকেই নজর দিতে হবে৷ বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে ৷ কিন্তু সামনে আরো অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে৷ যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থার আরো উন্নয়ন করার জন্য গুরুত্ব দিতে হবে৷ পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারনা ত্যাগ করে সমাজকে ন্যায্যতা, যুক্তি আর জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে৷ সর্বত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে৷ নারীর প্রতি সহিংসতা নির্র্মূল করে নারীকে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ আমাদের সংবিধানে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীনতার যে নিশ্চয়তা প্রদান করেছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে৷ সেজন্য সরকারসহ বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে৷ সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে পরিবার ও সমাজে নারীর সম্মানজনক অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে৷