সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উড্ডয়ন
১৬ ডিসেম্বর ২০২১সেখানে তিনি বলেছিলেন: ‘‘একটা প্রশ্ন সবাই ক্রমাগত করে যাচ্ছেন: ‘বাংলাদেশ কি টিকে থাকতে সমর্থ (ভায়াবল) হবে?’ এই প্রশ্নের জবাব কোনো অর্থনীতিবিদের কাছে নেই৷ টিকতে থাকতে সমর্থ না হওয়ার বিকল্প কী? মৃত্যু? কখনো কোনো দেশ কি মৃত্যুবরণ করেছে? এটা গরিব হতে পারে৷ হতে পারে স্থবির৷ কিন্তু একটি দেশ কি টিকে থাকতে অসমর্থ হয়?... বাংলাদেশ কি অতীতের অর্থনৈতিক কাঠামো ও প্রবণতা ধরে রেখে এগিয়ে যেতে পারবে এবং তা উচচহারে খাদ্য আমদানি ও প্রধান পণ্য রপ্তানির স্থবিরতা বজায় রেখে? বাংলাদেশ কি ধীরস্থির ও ক্রমাগত ভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে? বাংলাদেশ কি অতীতের ভীষণ গরিবী থেকে সরে আসতে পারবে৷’’
এসব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রবিনসন বলেছিলেন যে বাংলাদেশ অতীতের অতীতের অর্থনৈতিক কাঠামো বজায় ধরে রেখে সামনে যেতে পারবে না৷ আর তাই সেসময় [খাদ্যে] স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কৃষিনীতি এবং ক্ষুদ্রায়তন শিল্প–কারখানা গড়ে তোলার শিল্পনীতির মাঝে তিনি অতীতের কাঠামো বদলের পরিকল্পনার প্রতিফলন দেখেছিলেন৷ তিনি একই সঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে প্রবল গরিবী থেকে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির পথে উঠে আসা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়া বেশ কঠিন৷
রবিনসন বরং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন৷ সেখানে তিনি জনসংখ্যার বিস্ফোরণকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বলেন যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যখন এক থেকে সোয়া এক শতাংশে বা এর কাছাকাছি নামিয়ে আনা সম্ভব হবে, তখনই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে স্ব-টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকে ধাবিত হবে আর তাও অগ্রসর দেশগুলোর মতো হারে৷ বস্তুত রবিনসন নবজাত বাংলাদেশকে ঘিরে হতাশার বদলে সতর্কভাবে আশাবাদী হয়েছিলেন, যদিও তা খুব জোরালো ছিল না৷
প্রায় পাঁচ দশক পরে এসে আজকে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তখন রবিনসন বেঁচে থাকলে বিস্মিত হতেন বৈকি৷ তিনি ও তাঁর মতো যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি কিছুটা বন্ধুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী বজায় রেখেছিলেন, তারা হয়তো বা আফসোসও করতেন যে বাংলাদেশ নিয়ে জোরাল আশাবাদ ব্যক্ত না করায়৷
তলাবিহীন ঝুড়ি
অবশ্য ১৯৭১ সালের নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশটি বিশ্বের মানচিত্রে লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, সে দেশটির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের অন্ত ছিল না অনেকের৷ সংশয়বাদীদের কেউ কেউ এমনও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, দেশটি হয়তো টিকবেই না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভায় বাংলাদেশকে বাস্কেট কেস বা তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়৷ এর ১০দিন পরেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করে৷ তবে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা সেঁটেছিল বহুদিন৷ আর প্রথম তিন বছরের মধ্যেই নানা ধরণের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপরযয় এই তকমাকে যেন সত্যি প্রমাণ করার দিকেই ধাবিত হচ্ছিল৷ বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদেশি সাহায্য ও খাদ্য সাহায্য কমে যাওয়া, বাণিজ্যে ধ্বস, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, চোরাচালান, দুর্ভিক্ষ, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি – যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি গরিব দেশ ভেতর ও বাইরের এতোসব নানামুখী প্রতিকূলতায় দিশেহারা ৷ অথচ তলাবিহীন ঝুড়ির প্রচারকরা এ বিষয়গুলোর সেভাবে বিবেচনায় নেননি বা নিতে চাননি৷ তাঁরা অনেকে পরর্বতীতে এটাও দেখেননি যে সীমিত সম্পদ-সহায়তা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশ পুনর্গঠনের যেসব নীতি ও পদক্ষেপ নিয়েছিল, বৈশ্বিক ও প্রাকৃতিক পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠতে শুরু করতেই তার সুফল দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৭৬ সালেই৷
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে যা পূর্বাভাসই দিয়ে থাকুক কেন, সময় যতো গড়িয়েছে বাংলাদেশ ততোই নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি ও পদক্ষেপগুলো সংশোধন, নবায়ন ও সমন্বয় করেছে৷ এ থেকে সবসময় সুফল না মিললেও অর্থনীতির চাকা কখনো থমকে যায়নি, যদিও সামনে চলার গতি মাঝে-মধ্যে শ্লথ হয়ে পড়েছে৷ আর তাই অনেক অপ্রাপ্তি-হতাশা-ব্যর্থতার গ্লানির মাঝেও ৫০ বছর ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশের সার্বিক অর্জন একাধারে বিস্ময়কর ও ঈর্ষণীয়৷ স্বাধীনতার ৫০ বছর বা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে এক অনন্য ব্যাপার৷
প্রবৃদ্ধির প্রয়াস
শুরুর বছরগুলোয় উচ্চহারের আমদানি শুল্ক রেখে দেশীয় শিল্প সংরক্ষণ ও আমদানি-বিকল্প নীতিসহ সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রাষ্ট্র-কেন্দ্রিক উন্নয়ন নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়৷ তাই এ সময়ে বেসরকারি খাতের ভূমিকা ছিল নগণ্য, বিনিয়োগও খুব অল্প৷ তবে অচিরেই নীতি পরিবর্তন হয় বেসরকারি খাতকে সুযোগ করে দিতে৷ তাই আমদানি শুল্কহার কিছুটা কমানো হয়, রাষ্ট্রীয় কলকারখানা ব্যক্তিখাতে ছাড়া শুরু হয়৷ ফলে দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশের পথও খুলতে থাকে৷ সে কারণেই ১৯৭৮ সালে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে৷ রিয়াজ গারমেন্টসের তৈরি শার্টের প্রথম চালানটি ফ্রান্সে যায়৷ ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করার নীতি মধ্যবিত্তের বিকাশেও সহায়ক হয়ে ওঠে৷ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রতিফলন দেখা দেয়৷ স্বাধীনতার প্রথম দশকে (১৯৭২-১৯৮০) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল পৌণে দুই শতাংশ যা দ্বিতীয় দশকে (১৯৮১-৯০) গিয়ে দাঁড়ায় চার শতাংশে৷ বলা যেতে পারে, এই দুইটি দশক ছিল অর্থনীতির গতিমুখ নির্ধারণের কাল, প্রবৃদ্ধির ভিত্তি ও পাটাতন গঠনের কাল৷ যেমন, প্রথম দশকেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের অভীষ্ট নির্ধারিত হয়েছিল যার পরবর্তী দশকগুলোয় কৃষি উৎপাদনকে চালিত করেছে৷ আবার এ সময়কালেই ঠিক হয়ে যায় যে বাংলাদেশ বাজারমুখী পুঁজিবাদী অর্থনীতির ছকে পরিচালিত হবে৷
১৯৯০-র দশকে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করে এবং বাজারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার কাজ শুরু হয়৷ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তিত হয়, টাকাকে আংশিক রূপান্তরযোগ্য করা হয়, আমদানি শুল্ক হার আরো কমানো হয়, অর্থনীতি দ্রুত উম্মুক্ত হতে থাকে৷৷ এসময় ব্যাংকিং তথা আর্থিকখাতে নানা সংস্কার হয়, বেসরকারিকরণ জোরদার হয়৷ একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা-সহিংসতা প্রবৃদ্ধির ক্ষরণ ঘটায়৷ ফলে বাংলাদেশের তৃতীয় দশকে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় পৌনে পাঁচ শতাংশ৷ এই সময়ে রাষ্ট্র তথা সরকার ও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি অসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো (এনজিও) অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷
প্রবৃদ্ধির উল্লম্ফন
পরের দশকেই উচচতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস বেশ জোরদার হয়ে ওঠে আমদানিখাত ব্যাপকভাবে খুলে দিয়ে, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা বাজারমুখী করে দিয়ে, সুদের হার কমানোসহ ব্যাংকখাতে বিভিন্ন সংস্কার এনে৷ এতে নানা-ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যের এবং কাজের সুযোগ তৈরি হয়৷ বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমে বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানি তথা বাণিজ্য-নির্ভর দেশে রূপান্তরিত হয়৷ বাণিজ্য-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয় যেখানে জিডিপিতে বিদেশি সহায়তার অনুপাত নেমে আসে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশে৷ আবার এই দশকের গড় প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে পাঁচ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় যা দারিদ্রের হার কমিয়ে আনে৷ বিভিন্ন আঘাত মোকাবিলায় অর্থনীতির সহনক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়৷
উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য আগের চার দশকজুড়ে যেসব প্রয়াস নেওয়া হয়, তারই প্রতিফল মিলতে শুরু করে পঞ্চম দশকে এসে (২০১১-২০২০)-- এই দশকে গড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ছয় শতাংশে উন্নীত হয়৷ বড় বড় অবকাঠামো বিনির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়, টেলিযোগাযোগ ও ডিজিটালয়নে বড় ধরণের অগ্রগতি হয়৷ দশকের মাঝামাঝি এসে বাংলাদেশ নিম্ন-আয়ের দেশের কাতার থেকে নিম্ন-মধ্য-আয়ের দেশের সারিতে উঠে আসে৷ এই দশকেই স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের বিষয়টিও নিশ্চিত হয়ে যায় দারিদ্র কমে যাওয়া, মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি আর সামাজিক বিকাশের কারণে৷ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ( যেমন শিশু মৃত্যু হার কমানো, সুপেয় পানি সরবরবাহ, ক্ষুধা হ্রাস) ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ৷ দশকের মাঝামাঝি সময়েই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশ ছাড়িয়েছিল - কোভিড-১৯ আঘাত না হানলে যা দশকের গড় হার হতো৷
শেষ কথা
বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫০ বছরের অভিযাত্রাকে মোটাদাগে পাঁচটি দশকে ভাগ করে দেখানোর যে চেষ্টা এখানে করা হয়েছে, তার সাথে রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে, রয়েছে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিষয়টি৷ বাজারভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথ গ্রহণ করা হলেও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিপতি ও শিল্পপতি গড়ে তোলার প্রবণতা প্রথমে অনুপার্জিত আয় ভোগীদের (রেন্ট সিকারস) বিস্তার ঘটিয়েছে৷ একটা সময়ে এসে তা রূপ নিয়েছে স্বজনতোষী (ক্রনিজম) অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে৷ আর ব্যবসা-রাজনীতির যোগসাজশ বেড়েছে৷ অনিয়ম-দুর্নীতির দৌরাত্ম নতুন মাত্রা নিয়েছে৷ এসবের ফলে সমাজে আয়সহ বিভিন্ন বৈষম্য বেড়েছে যা খেটে খাওয়া শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের প্রকৃত আয়ের ওপর আঘাত হেনেছে৷ এই বৈষম্য কমিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যার সফল মোকাবিলা বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিবাচক অর্জন ও সাফল্যগুলোকে আরো পোক্ত করবে, প্রবৃদ্ধির উড্ডয়নকে করবে টেকসই৷