‘সেল্ফি' তুললেই মুক্তি?
৫ জুলাই ২০১৫হ্যাশট্যাগটি হলো – #সেল্ফিউইথডটার, মানে কন্যা সন্তানের সঙ্গে সেল্ফি৷ হ্যাঁ, জুন মাসের রেডিও বার্তায় মোদী ঠিক এমনটাই করতে বলেছেন ভারতের আপামর পিতৃকুলকে৷ আর তার পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় নেমেছে পিতা-কন্যা সেল্ফির৷
নারী নির্যাতনের ঘটনা ভারতে নতুন কিছু নয়৷ অহরহ শ্লীলতাহানির ঘটনায় ভারতকে আজ অনেকেই ‘ধর্ষণের দেশ' বলতে পিছ-পা হন না৷ সাধারণ, গরিব ঘরের মানুষ তো কোন ছাড়, অভিনেত্রী, মডেল, পেশাজীবী নারীর প্রতিও নির্যাতনের অন্ত নেই এ দেশে৷ রয়েছে ভ্রূণ হত্যা, শিশু বিবাহ এবং বহু বিবাহের মতো ঘটনাও৷
কন্যা সন্তান আজও কাঙ্খিত নয় ভারতে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তানসম্ভবা কোনো নারীকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় – আপনি পুত্র না কন্যা সন্তান চান? উত্তর নিশ্চিত – ছেলে৷ তা সে উত্তর নিজস্ব হোক অথবা পারিবারিক চাপের কারণে৷ কন্যা সন্তান জন্মালেই যে রয়েছে বিয়ের খরচ৷ তার ওপর বংশরক্ষার ক্ষেত্রেও তার কোনো ভূমিকা নেই৷ দুঃখের বিষয় এ দু'টি ধারণা বিজ্ঞান ও আধুনিকতার সব বাধা পেরিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতেও টিকে গেছে৷
এবার ভারতের সেই চিরাচরিত ছবিটিকেই ‘সমূলে' উৎপাটন করতে চান মোদী৷ বেশ, ভালো কথা৷ জন্মের আগে সন্তানের লিঙ্গ শনাক্ত করে আর যাতে গর্ভপাত না করা হয়, যাতে ছেলেদের মতো মেয়েরাও সমান শিক্ষা পায়, নিজের পেশা, জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারে, নিতে পারে নিজ সিদ্ধান্ত – এ সবের জন্য একটা সেল্ফি তোলা কি আর তেমন কষ্টসাধ্য? সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদীর মতো এমন হিড়িক তুলেই তো যুগ যুগান্তরের সমস্ত তমসা আমরা দূর করতে পারি, তাই না?
তাই তো, অতি সাধারণ থেকে অনন্য সাধারণ, বলিউডের নামি-দামি অভিনেতা থেকে আমলা-মন্ত্রী, রাজনীতিক – বাপ-বেটির ফটো তুলে ‘পোস্ট' করার ধুম লেগেছে ভারতে, এমনকি ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও৷ সেল্ফি পোস্ট করলেই যে আজকাল ‘অ্যাক্টিভিস্ট'-এর তকমা পাওয়া যায়! মিটিং-মিছিল, রাস্তায় গিয়ে স্লোগান দেওয়া – এ সবের যে আজ আর কোনো প্রয়োজন নেই, ভাবটা এমনই৷ তার ওপর খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অর্থাৎ তা শিরোধার্য৷ তাছাড়া এতে যদি কাজ হয়, নারীর নির্যাতনের প্রতি জনমানসে সচেতনতা বাড়ে, তাহলে বাহবার প্রাপক হবেন একমাত্র মোদী৷ আর আমরা, মানে নারীরাও আশ্বস্ত হবো৷
কিন্তু ভারতীয় সমাজের শুদ্ধিকরণের জন্য হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডাধারী মোদীর কোনো অভিযানকেই যে আমি সরল বলে মেনে নিতে পারি না, অত্যন্ত এখনও পর্যন্ত৷ কারণ মোদী গৈরিক ধ্বজা না দেখালেও, রাজ্যে রাজ্যে, শহরে শহরে শ্লীলতাহানি আর ধর্ষণের প্রকোপ কমাতে পারেননি৷ এমনকি মোদী-ভক্তদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছেন এমন সব পুরুষ, যাঁরা নারীকে সম্মান করতে জানেন না৷ নারীকে কুচোখে দেখেন আর বেশ্যা, পতিতা, মাগি, নষ্ট মেয়ে, এমনকি গায়ের রং কালো হলে ‘নিগ্রো' বলে গালাগালি দিতেও মুখে বাধে না তাঁদের৷ আর সেটা এই ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' আন্দোলনের সময়ও উঠে এসেছে বারে বারে৷
হ্যাঁ, আমি বলছি কবিতা কৃষ্ণণকে নিয়ে বিতর্কের কথা৷ আমার পূর্ব পরিচিত বলে বলছি না৷ কিন্তু নিতান্তই সাধারণ দু'টি টুইট করেছিলেন কবিতা৷ বলেছিলেন, ‘‘#সেল্ফিউইথডটার ব্যবহার করার সময় ‘সাবধান'৷....প্রশ্ন তুলেছিলেন মোদী এই ‘মন কি বাত'-এর মাধ্যমে তাঁর কথিত বোন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, রাজস্থানের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ইত্যাদিদের বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ আড়াল করতে চাইছেন না তো?...''
মানছি কবিতা উগ্র-বামপন্থি রাজনীতি করেন৷ তাই হয়ত সেই টুইটার-বার্তায় মোদী প্রসঙ্গে তীর্যক উক্তি ছিল৷ কিন্তু বিশ্বের সর্ব বৃহৎ গণতন্ত্রটি কি শুধুই একপেশে? ক্ষমতাশীলকে প্রশ্ন করার অধিকার থেকে কি ভারতীয়রা আজ বঞ্চিত? নিশ্চয় তাই৷ তা না হলে সরকারের পোষা ‘নারী মুক্তি অভিযান'-এর বিপক্ষে কথা বললেই মোদী-ভক্তরা একে একে কবিতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন কেন? কেন দলে দলে তাঁরা যোগ দিলেন কবিতাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিতে?
ভারতীয় পুরুষের অধিকাংশই যে এখনও নারীবিদ্বেষী, নারীকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' হিসেবে দেখা অন্ধ, এক-একটি ‘মিসোজিনিস্ট', তা তাঁদের এ আচরণ থেকেই প্রকাশ পায়!