মনের কাঁটাতার দূর না হলে ‘বন্ধুতা’ অসম্ভব
১৫ মার্চ ২০১৫
গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা যে দেশে গিয়ে এক হয়েছে, সেই দেশের নাম বাংলাদেশ৷ ভারতবর্ষের দীর্ঘতম সীমান্ত এই দেশটিরই সাথে৷ একদিকে পশ্চিমবঙ্গ, অন্যদিকে আসাম, মেঘালয় অথবা ত্রিপুরা – ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের যে উপায় নেই৷ দুই বাংলার ভাষা এক, সংগীত-সাহিত্যও মিলেমিশে এক হয়েছে৷ কিন্তু তারপরও রয়ে গেছে কাঁটাতারের বেড়া৷
না, আমি শুধু ভৌগোলিক বেড়ার কথা বলছি না৷ বাংলাদেশের চারিপাশে এ বেড়া দিয়ে সন্ত্রাসী, থুড়ি, অভিবাসীদের যাতায়াত বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছে মাত্র৷ প্রমাণ করা হয়েছে দেশটার ওপর আস্থা রাখা চলবে না৷ তা ভারত-বাংলাদেশ যদি বন্ধুই হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া থাকা যে সত্যিকার অর্থেই অনুচিত৷ তবে এ আর বেশি কি?
আমি আসলে বলছি মানসিক কাঁটাতারের কথা৷ ভারত একটি উপমহাদেশ, তাই তার চেহারাটা বড়সড়৷ কিন্তু তাই বলে আজন্ম আধিপত্য? অনেক ভারতীয়কেই বলতে শুনেছি, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একটা বড় হাত ছিল ভারতের৷ বেশ তো, ছিল৷ মানছি৷ কিন্তু তাই বলে শুধু ভারতের সহায়তার কারণেই বাংলাদেশের জন্ম – এ কথা তো মেনে নেয়া যায় না৷ কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যায় না মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ন’মাস, অগুনতি মানুষের রক্তকে৷
না, আমার কথা এমনি এমনি মানতে হবে না৷ আমি বরং একটা উদাহরণ দেই৷ বাংলাদেশে অবাধে ভারতীয় চ্যানেলগুলো দেখানো হয়৷ অথচ ভারতে বাংলাদেশি কোনো চ্যানেল দেখা যায় না৷ ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোয় বাংলাদেশের অস্তিত্বও তথৈবচ৷ তাই দেশটির উন্নয়ন, নাটক, গান অথবা সমাজ সম্পর্কে জানার কোনোরকম সম্ভাবনাই নেই ভারতবাসীর৷ এই কাঁটাতারের বেড়া কি আরো মর্মান্তিক নয়?
অথবা ধরুন ‘দ্বিপাক্ষিক’ বিনিয়োগ৷ না, না, দ্বিপাক্ষিক বলাটা যে ভুল হলো৷ কারণ মূল বিনিয়োগটা তো করছে ভারত৷ বাংলাদেশ ভারতে আর বিনিয়োগ করলো কই? তাই স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে চলেছে ভারসাম্যহীনতা৷ তার ওপর টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তা চুক্তি নিয়ে চলছে প্রহসন৷ দক্ষিণ বেরুবাড়ীর বিনিময়ে তিনবিঘা করিডরের অধিকার, সীমান্ত হত্যা বন্ধে রাবার বুলেটের প্রতিশ্রুতি – ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ সবের কিছুই এখনও রক্ষা করেনি৷
তাই এবার, মানে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে সব কিছু ‘ঠিক’ হয়ে যাবে – বুকে হাত রেখে এ কথা অন্তত আমি বলতে পারছি না৷ ট্রানজিট এবং সীমান্তে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুগুলি মেনে নিলেই যে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক সংক্রান্ত বাধা দূর হবে অথবা অভিন্ন নদী থেকে বাংলাদেশ ন্যায্য পানির অংশ পাবে – এমন প্রতিশ্রুতি দেবে কে?
মোদী অবশ্য দিল্লির মসনদে বসার মুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশকে পাশে রাখতে চেয়েছেন৷ তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সংসদের স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী৷ এরপর একে একে বাংলাদেশে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কিনা তিস্তা নদীর জলবণ্টন চুক্তিকে পণবন্দি করে রেখেছিলেন৷ অন্যদিকে ভারত থেকে ঘুরে গেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ৷ প্রত্যেকটি সফরেই মূলত দু’টি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে৷ তিস্তা চুক্তি, যা ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সই করেও কার্যকর করতে পারেননি৷ আর দ্বিতীয়টি হলো স্থলসীমা চুক্তি বা ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল হস্তান্তর৷ মোদীর কথায়, চুক্তি দু’টি কার্যকর করতে তাঁর সরকার অত্যন্ত ইতিবাচক৷
ভালো৷ আর তো মাত্র কয়েকটা দিন৷ তারপর নিজেই বাংলাদেশে যাবেন মোদী৷ এ জন্য মমতার সঙ্গে ইতিমধ্যে বৈঠকও করেছেন তিনি৷ দীর্ঘদিনের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে এবার হয়ত মমতা মেনে নেবেন কেন্দ্রের ইচ্ছেটুকু৷ কিন্তু এ সব হলেই কি মনের কাঁটাতারের বেড়াটা উধাও হয়ে যাবে? থাকবে না কোনো আশঙ্কা?
আমার কিন্তু মনে আছে, কলকাতা বন্দর বাঁচানোর অজুহাতে ফারাক্কা বাঁধ করার পরও সে বন্দরকে বাঁচানো যায়নি৷ অথচ এর ফলে বাংলাদেশের বহু নদ-নদী এক হয় মরে গেছে অথবা মৃতপ্রায়৷ এমনকি তিস্তা নদীর উজানে ব্যারাজ করা হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই৷ আর এখন ভারত চাইছে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরে প্রবেশাধিকার৷ চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার ওপর যথেষ্ট চাপ সত্ত্বেও সেটা যদি করা হয়, তাতে তো ভারতেরই লাভ৷ বাংলাদেশের কথা কি আদৌ তার ‘বন্ধুটি’ ভাবছে? বাংলাদেশের পণ্য যে এখনও ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না৷ মান নিয়ন্ত্রণের নামে কড়াকড়ির জন্য দেশটির শুকনো ও হিমায়িত খাদ্য, ওষুধ, চামড়ার জিনিস এবং তৈরি পোশাক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে৷
তাহলে এ ‘বন্ধুতা’ কি শুধুই একটা অলীক স্বপ্ন নয়? যে দেশ তার ক্ষমতা আর আধিপত্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, বারে বারে নিরাশ করে একটা গরিব দেশের জনগণকে, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে একটা আপোশ ছাড়া আর কী বলবো?