সিরিয়ায় অপহৃত জার্মান সাংবাদিক মুখ খুললেন
১১ এপ্রিল ২০১৯একসময়ের সহপাঠী লাওরার সাক্ষাৎ পেতে ২০১৫ সালের শরৎকালে সিরিয়া গিয়েছিলেন সাংবাদিক ইয়ানিনা ফিন্ডআইসেন৷ তারও দশবছর আগে লাওরা জিহাদি যোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিতে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন৷ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াইরত জিহাদিদের একান্ত ফুটেজ পাওয়ার আশায় লাওরার সহায়তা চেয়েছিলেন ফিন্ডআইসেন৷
লাওরার মাকে সঙ্গে নিয়ে তাই বিমানে করে জার্মানি থেকে তুরস্কের আন্টাকিয়ায় পৌঁছান তাঁরা৷ সেখানে তাঁদের সঙ্গে কয়েকজন মানবপাচারকারীর দেখা হয় যাঁরা তাঁদের তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত পার করে দেয়ার কথা বলেন৷ সীমান্তে তখন বেশ বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল৷ সীমান্তরক্ষীরা একদিকে শরণার্থীদের মারছিলেন, অন্যদিকে সীমান্তের কাছেই বোমা ফুটছিল৷ সেই অবস্থা দেখে লাওরার মা নিজের মত পরিবর্তন করে জার্মানিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন৷ তবে, ফিন্ডআইসেন ভ্রমণ সতর্কতাকে অগ্রাহ্য করে সিরিয়ায় প্রবেশ করেন৷
ফিন্ডআইসেন জানান, লাওরা তাঁকে ইমেলে সিরিয়ায় তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু শুধু সেই প্রতিশ্রুতি যে দেশটি ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট ছিল না, তা বুঝতে তাঁর বেশি সময় লাগেনি৷
ভ্রমণ যখন বিপজ্জনক দিকে মোড় নেয়
মানবপাচারকারীদের সহায়তায় অক্ষত অবস্থায় সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে প্রবেশের পর লাওরার দেখা পান তিনি৷ প্রথম আটদিন সেখানে তুলনামূলকভাবে ভালোই কেটেছিল৷ ফিন্ডআইসেন বলেন, ‘‘সে তখনও আমার বন্ধু ছিল, আমরা অতীতের স্মৃতিচারণ করেছি৷ তবে এটাও ঠিক যে আমরা স্কুলত্যাগ করার পর অনেক কিছু ঘটেছে৷ ফলে আমাদের মধ্যে অনেককিছু ভিন্ন ছিল৷'' তা সত্ত্বেও তাঁরা একে অপরকে বিশ্বাস করেছিলেন৷ ফিন্ডআইসেন সেসময় লাওরা এবং নুসরা ফ্রন্ট নামের সন্ত্রাসী সংগঠনের এক কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন৷ লাওরা সেই ফ্রন্টের একজন সদস্য ছিলেন৷
ফিন্ডআইসেন এবং লাওরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ঘুরেও বেড়িয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা উত্তর সিরিয়ার মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঘুরেছি, ইডলিবের মধ্যে গিয়েছি এবং গাড়ি থেকে ভিডিও করেছি৷'' তিনি তখন বিভিন্ন চেকপয়েন্ট এবং বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত শহরতলী দেখেছেন৷ এভাবে পর্যাপ্ত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের পর তিনি লাওরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটি ট্যাক্সিতে করে তুরস্কের সীমান্তের দিকে রওয়ানা দেন৷ ট্যাক্সিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন নুসরা ফ্রন্টের এক যোদ্ধা৷
কিন্তু সীমান্তে পৌঁছানোর অল্প কিছুক্ষণ আগে তাঁর ট্যাক্সি থেমে যায়৷ ফিন্ডআইসেন বলেন, ‘‘ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকেই আমি মন্দ কিছুর ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম৷ ট্যাক্সি চালক কখনো খুব জোরে, কখনো খুব আস্তে চালাচ্ছিল৷ একপর্যায়ে হঠাৎ করে কালাশনিকভ হাতে একদল মুখোশধারী পুরুষ আমাদের গাড়িটি আটকে দেয়৷''
মুখোশধারীরা ট্যাক্সির চালক এবং নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধাকে ট্যাক্সি থেকে বের করে দেয়৷ তাদের একজন তখন ফিন্ডআইসেনের পাশে বসে৷ সেসময় মৃত্যুর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকলে চুপচাপ বসেছিলেন তিনি৷ কেননা তিনি জানতেন সেই মুহূর্তে আসলে তাঁর কিছু করার ছিল না৷
জিম্মিদশায় সন্তান প্রসব
অপহরণকারীরা ফিন্ডআইসেনের চোখ বেঁধে ফেলে এবং ট্যাক্সিটি চালিয়ে এক অজানা গন্তব্যে নিয়ে যায়৷ এরপর কয়েকমাস পরপর তাঁকে রাখার স্থান বদল করা হয়৷ তাঁকে সবসময় চোখ বেঁধে এক স্থান থেকে অন্যত্র নেয়া হতো এবং তাঁকে কোথায় রাখা হচ্ছে তা জানাতো না জিম্মিকারীরা৷
ফিন্ডআইসেন অবশ্য তাঁর জিম্মিকারীদের সব নির্দেশনা মেনে চলতেন৷ তিনি শান্ত থাকতেন, কখনো চিৎকার বা পালানোর চেষ্টা করতেন না৷ জিম্মিকারীরা তাঁকে খাবার এবং পোশাক এনে দিত৷ তবে, তাঁর রুম থেকে বের হতে নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ একপর্যায়ে তাঁকে একটি টেলিভিশন দেয়া হয়েছিল৷ বিদ্যুৎ থাকলে তিনি সেই চ্যানেলে ডয়চে ভেলে দেখতেন - তাঁর কাছে বহির্বিশ্বে কী হচ্ছে, সেটা জানার ওটাই একমাত্র মাধ্যম ছিল৷
একসময় ফিন্ডআইসেনের সন্তান প্রসবের সময় হয়৷ তিনি আশা করেছিলেন যে তাঁর জিম্মিকারীরা তাঁকে কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবেন৷ কিন্তু তারা সেটা করেনি৷ সেসময়কার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘‘তারা আমাকে দেখভালের জন্য উত্তর সিরিয়া থেকে এক স্ত্রীরোগ চিকিৎসক নিয়ে আসেন৷ আমাকে দেখভালে বাধ্য করার জন্য তারা তাঁর স্বামীকে জিম্মি করেছিল৷'' সেই স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ফিন্ডআইসেনকে জানান যে তাঁর বা তাঁর সন্তানের কিছু হলে জিম্মিকারীরা চিকিৎসকের স্বামীকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছিল৷
ফিন্ডআইসেন জানতেন তাঁকে যে-কোনো সময় ক্যামেরার সামনে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হতে পারে৷ তা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে শান্ত রাখতে ডয়চে ভেলে দেখতেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ভালো ঘটনা মনে করতাম, আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবনকাল এবং অতীতে আমি নিরাপদ ও সমৃদ্ধ যে জীবন কাটিয়েছিলাম সেই জীবনের কথা৷'' প্রতিদিন ডয়চে ভেলে টেলিভিশন দেখে এবং এসব ভেবেই তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করতেন৷
অবশেষে মুক্তি
এগারো মাস পর একদিন হঠাৎ করে একদল মুখোশধারী ব্যক্তি তাঁকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে অভিযান চালিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন৷ তাঁরা তাঁর নাম ধরে ডাকেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান৷ সেই মুহূর্তে অবশ্য ঠিক কী হচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করেছিলাম অন্য একটি জিহাদি গোষ্ঠী আমাকে নিয়ে যাচ্ছে৷'' আরেক অপহরণকারী দলের কাছে যাচ্ছেন ভেবে তিনি শঙ্কিত বোধ করছিলেন৷
ফিন্ডআইসেনের উদ্ধারকারীরা তাঁর চোখ খুলে দেন এবং তাঁকে ও তাঁর সন্তানকে তুরস্ক সীমান্তে নিয়ে যান, যেখানে জার্মান সিকিউরিটি এজেন্টরা তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন৷ এভাবেই আবার মুক্ত জীবনে ফিরে আসেন এই জার্মান সাংবাদিক৷
ফিন্ডআইসেন অবশ্য পরবর্তীতে শুনেছিলেন যে নুসরা ফ্রন্টের অন্য একটি উপদল, যারা বছরখানেক আগে তাঁর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, দৃশ্যত তাঁকে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন৷
এখন অবশ্য ফিন্ডআইসেন স্বীকার করেন যে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাঁর যুদ্ধাঞ্চলে যাওয়া একেবারেই উচিত হয়নি৷ তিনি তাঁর সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন৷ ‘‘বই লেখাটা আমাকে সেই ঘটনার কারণে সৃষ্ট মানসিক ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করেছে,'' বলেন তিনি৷
সোনিলা সান্ড/এআই