ইসলামিক স্টেট কি নির্মূল হলো?
৩০ মার্চ ২০১৯মার্কিন সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় প্রায় ৫২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করে তাঁরা৷ কম মূল্য দিতে হয়নি এরজন্য৷ পাঁচ বছরের এ যুদ্ধে প্রায় ১১ হাজার সহযোদ্ধাকে হারিয়েছে তারা, জানালেন এসডিএফ প্রধান মাসলোম কোবানি৷
আইএস এর সর্বশেষ ঘাঁটিটি দখলে নেয়ার পর বাঘুজের একটি ভবনের উপর হলুদ রঙের পতাকা উড়িয়ে বিজয় উদযাপন করেছে তারা৷ উদযাপন দেখে কিছুটা হলেও আঁচ করা গেছে এলাকাটি পুনরুদ্ধারের জন্য কতটা মরিয়া ছিল এসডিএফ৷
আর এর মধ্য দিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে সিরিয়াতে থাকা আইএস-এর সমাপ্তি ঘটলো বলে ধারণা করছেন বিশ্ব নেতারা৷ বাঘুজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার বিষয়টিকে উদযাপন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আইএস-এর পুনরুত্থানের বিষয়ে সতর্ক থাকবে৷
তবে ঘোষণা দিয়ে আইএস উচ্ছেদের খবর প্রকাশিত হলেও, নির্মূল হলো কি জঙ্গিগোষ্ঠিটি? বিশেজ্ঞরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে আইএস-এর দখলে থাকা অংশগুলো পুনর্দখলের মধ্য দিয়ে তাদেরকে পিছু হটানো গেলেও যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের আবারো জড়ো করার ও বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর বিষয়ে নজর রাখা জরুরি৷
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বিশেষজ্ঞ ও সিরিয়ার স্থানীরা বলছেন, সিরিয়া থেকে আইএসকে হটানো গেলেও তাদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া উচিত হবে না৷ কেননা, এ জঙ্গি গোষ্ঠীটি যে-কোনো সুযোগে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারে৷
দ্যা সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যারন লুন্ড বলেন, নিজেদের সংগঠিত করার জন্য আইএস-এর সদ্যস্যরা যে-কোনো সম্ভাব্য সুযোগকেই কাজে লাগাতে চাইবে৷
একই মত ব্যক্ত করেন, লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা আইএইচএস মার্কিট-এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক কলাম্ব স্ট্র্যাক৷ তাঁর মতে, জঙ্গিগোষ্ঠীটি ইতিমধ্যে ইরাক, সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে৷ আর এর মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারে তারা, বলেন তিনি৷
এদিকে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে নিজেদের সংগঠিত করছে আইএস৷ আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে তারা আবারো প্রত্যাবর্তন করতে পারে বলে ধারণা করছে পেন্টাগন৷
যেভাবে সংগঠিত হতে পারে আইএস
গত কয়েক বছর ধরে সংগঠনটির চরিত্র বিশ্লেষণ করে এর সম্ভাব্য পুনরুত্থানের বিষয়টি ধারণা করা যেতে পারে৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটি তাদের কার্যক্রম সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক পরিচালনা করলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগঠনটিতে যোগ দিতে গেছে হাজারো যোদ্ধা৷
নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দ্য সোফান সেন্টার বলছে, ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বের ৮৫টি দেশ থেকে প্রায় ৩০ হাজার যোদ্ধা এ জঙ্গিগোষ্ঠীটিতে যোগদান করে৷ তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১২০টি দেশ যেমন আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, টিউনিশিয়া থেকে প্রায় ৪০ হাজার যোদ্ধা যোগ দিয়েছে এই জঙ্গিগোষ্ঠীতে৷ যাদের অনেকেই নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন বা অন্য কোনো স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন৷
এদিকে সারাবিশ্ব থেকে অনুসারী সংগ্রহের ক্ষেত্রে আইএস-এর প্রধান লক্ষ ছিল তরুণরা৷ আর তাঁদের যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷
সিরিয়া কিংবা ইরাক থেকে তাদের স্থাপনা উচ্ছেদ করে দেয়া গেলেও বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে৷ আর এ বিষয়টি মাথায় রেখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট খুব সতর্ক করেন তরুণদের৷ তিনি বলেন, তরুণরা খুব সহজেই আইএস-এর প্রলোভনের শিকার হতে পারে৷ ইন্টারনেট ব্যবহার করা তরুণরা যদি আইএস-এর প্রপাগান্ডায় বিশ্বাস করে তাহলে তারা মৃত্যু মুখে পতিত হবে, বলেন তিনি৷
বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া আইএস সদস্যরা ওই অঞ্চল সমূহের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করে আল-জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াটার লু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেসমা মোমানি বলেন, বিভিন্ন দেশে ফিরে যাওয়া আইএস সদস্যদের উপর দৃষ্টি রাখতে হবে৷
বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়া আইএস সদস্যদের হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আইএস এর সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তারা আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে৷
জাতিসংঘের ২০১৬ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বের প্রায় ৩৪টি সমমনা সংগঠন আইএস খিলাফতকে সমর্থন দিয়েছে৷ যে কারণে সিরিয়া বা ইরাক থেকে বিতাড়িত হলেও সমমনা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আবারো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷
এদিকে সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলোসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে ঐ এলাকার অস্থিতিশীল পরিবেশকে পুঁজি করে আবারো জড়ো হতে পারে আইএস, মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
চার বছরের বর্বরতা
‘‘২০১৫ সালের গ্রীষ্মকাল৷ শহরের কেন্দ্রে পড়ে আছে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির শিরচ্ছেদ করা দেহ৷ দাফন করাতো দূরে থাক, তাঁর মৃতদেহের কাছেও ঘেঁষতে দেয়নি কাউকে৷ তার অপরাধ: আইএস-এর দখলদারিত্বের প্রতিবাদ করেছিল সে,'' এভাবেই আইএস এর হিংস্রতার বর্ণনা দিলেন এক সময়ের আইএস অধ্যুষিত অঞ্চল রাকা থেকে পালিয়ে আসা সিরীয় যুবক সামের (ছদ্মনাম)৷ এ সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দ্যা রাক্কা ডায়েরিস' নামে একটি বই লিখেন তিনি৷ সামের লিখেছিলেন, স্থানীয় তরুণীরা ছিল আতঙ্কের মধ্যে, কখন ধরে নিয়ে যায় দায়েশ (আইএস এর আরবি নাম)৷
২০১৪ সালের জুন মাসে সিরিয়া ও ইরাক অধ্যুষিত অঞ্চলে নিজেদের খেলাফত ঘোষণা করে জঙ্গি সংগঠনটি৷ হিংস্রতা ছড়িয়ে দিয়ে জনগণকে আতঙ্কিত করতে চাইতো তারা৷ প্রায় পাঁচ বছরের এ সময়টিতে সংখ্যালঘুদের উপর ও তাঁদের সাথে দ্বিমত পোষণকারীদের উপর নির্যাতনের চিত্র দেখা যেত প্রকাশ্যেই৷