সিবিআই বনাম মমতা
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯মূল ঘটনার শুরু রবিবার সন্ধেয়৷ কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের সরকারি নিবাসে আচমকাই একদল সিবিআই অফিসারের আসা এবং পাহারায় থাকা পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের বচসায় জড়িয়ে পড়া থেকে৷ সিবিআই অফিসারদের নজিরবিহীনভাবে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ৷ কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু তার মধ্যেই কেন্দ্র-রাজ্য তীব্র সংঘাতের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায়৷ যার প্রতিবাদে রবিবার রাত থেকে ধর্নায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ রাতারাতি তিনি প্রশাসক থেকে চলে গেছেন বিরোধী নেত্রীর চেনা ভূমিকায়৷ সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় যে জায়গায় বসে নিজের নীতিগত অবস্থানে অনড় থেকে রাজনৈতিক সাফল্য পেয়েছিলেন, শুরু করেছেন ঠিক সেখান থেকেই, এবার যাকে মমতা বলছেন ‘সত্যাগ্রহ'৷ সারা দেশের বিজেপিবিরোধী নেতারা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন৷ ওদিকে সিবিআই বনাম রাজ্য পুলিশের বিরোধ পৌঁছে গেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে৷
সিবিআই-পুলিশের এই বিরোধের একটা পূ্র্বপ্রস্তুতিও ছিল৷ সারদা এবং রোজ ভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারিরতদন্তের সূত্রে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই গত অক্টোবর থেকে বারবার তলব করছে কমিশনারকে, কিন্তু তিনি নানা অজুহাতে হাজিরা এড়িয়ে যাচ্ছেন, এরকম একটা খবর বেশ কিছুদিন ধরেই হাওয়ায় ভাসছিল৷ সম্প্রতি, নির্বাচন কমিশনের ডাক পেয়েও সাড়া না দেওয়ায় এমনও রটে যায় যে, কমিশনার গা ঢাকা দিয়েছেন৷ বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যম এই নিয়ে খবর করে৷ তার প্রতিক্রিয়ায় কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পোস্টে এবং সাংবাদিকদের ডেকেও জানানো হয়, এই খবর অসত্য এবং অপপ্রচার, যারা এ ধরনের ভুল খবর ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারে পুলিশ৷
কিন্তু সোমবার সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই সরাসরি অভিযোগ আনলো, পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার, যিনি সারদা এবং রোজ ভ্যালি চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তে রাজ্য সরকারের গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল, বা এসআইটির শীর্ষে ছিলেন, তিনি নিজেই ওই মামলার অন্যতম ‘সম্ভাব্য অভিযুক্ত'৷ কারণ, অনেক তথ্য-প্রমাণ ‘নষ্ট' করে ফেলা হচ্ছে বলে সন্দেহ৷ কাজেই রাজ্য পুলিশের তদন্তে পাওয়া সারদা ও রোজ ভ্যালি চিট ফান্ড সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য-প্রমাণ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে সমর্পণ করতে হবে৷
বাড়িতে সিবিআই হানার পরই প্রথমে কমিশনার রাজীব কুমারকে দেখা যায় স্থানীয় থানায় যেতে, এবং তারপর ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসা মুখ্যমন্ত্রীর পাশেও তাঁকে দেখা যায়৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও রবিবার সন্ধের সিবিআই হানার খবর পেয়ে নজিরবিহীনভাবে পৌঁছে যান পুলিশ কমিশনারের বাড়ির সামনে৷ সেখানে তখন রাজ্য পুলিশের ডিজি, ডিআইজি এবং অন্যান্য শীর্ষকর্তারা হাজির হয়েছেন৷ রাস্তায় দাঁড়িয়েই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তারপর ওখানেই সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, রাজীব কুমার শুধু রাজ্যের, বা দেশের নয়, সারা পৃথিবীর সেরা পুলিশ অফিসারদের একজন৷ মমতা ব্যানার্জী মনে করেন রাজীব কুমারের সততা, দায়বদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না৷ তিনি আরো মনে করেন, তদন্তের নামে এ আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র৷ তিনি জানান, এর বিরুদ্ধে তিনি ধর্নায় বসবেন৷ তারপরই মমতা পৌঁছে যান ধর্মতলায় এবং অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করেন৷ সোমবার রাজ্য বিধানসভায় বাজেট প্রস্তাব পেশের দিন৷ সে বাজেট রাজ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষ৷ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ওই ধর্নামঞ্চের পাশের আলাদা ঘরে তিনি মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে বাজেট পাস করাবেন৷ কিন্তু ধর্না ছেড়ে নড়বেন না৷ বস্তুত সোমবার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে এক কৃষক সমাবেশে মমতা ভাষণ দেন ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে৷
রবিবার রাত থেকেই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বিহারের রাষ্ট্রীয় জনতা দল নেতা তেজস্বী যাদব সরাসরি মমতাকে ফোন করে সমর্থন জানান৷ উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী মায়াবতী, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ সিং এবং কর্ণাটকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া, অর্থাৎ গত ১৯ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মমতার ডাকা বিজেপিবিরোধী সমাবেশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই মমতাকে সমর্থন জানিয়েছেন, লড়াইয়ে পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন৷ এঁদের কেউ কেউ কলকাতায় চলে আসছেন বলেও সোমবারের খবর৷
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী রাজ্যের মুখ্যসচিব মলয় দে-কে ডেকে পাঠিয়ে তাঁর থেকে গোটা ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট নেন৷ এরপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে রাজ্যপাল ত্রিপাঠীর দফায় দফায় কথা হয়৷ বেলা বাড়তে আবার মুখ্যসচিবকে ডেকে পাঠান রাজ্যপা৷ এদিকে কলকাতায় নিজাম প্যালেস এবং সল্ট লেকের সিজিএ কমপ্লেক্সে সিবিআইয়ের অফিসে রবিবার রাত থেকেই কলকাতা পুলিশের পাহারা সরিয়ে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সিআরপিএফ বহাল হয়েছে৷ সোমবার সকালে সেই বাহিনী কলেবরে আরো বেড়েছে৷ মমতা ব্যানার্জি যেমন সারারাত ধর্নায় বসেছিলেন, সিবিআই দপ্তরেও ঘুম ছিল না৷ সারা রাত সিবিআই কর্তাদের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে৷
কলকাতা পুলিশের অভিযোগ ছিল, সিবিআই কোনো ওয়্যারেন্ট, কোনো নথি ছাড়াই কমিশনারের বাড়ি হানা দিয়েছিল৷ সিবিআই সেই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, তাদের কাছে দরকারি সব কাগজপত্রই ছিল৷ কিন্তু কলকাতা পুলিশ সেগুলি দেখতে অস্বীকার করে৷ এরপর যা হবে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মোতাবেক হবে৷
অন্যদিকে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তদন্তের প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীদের অতীতেও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার সামনে হাজিরা দিতে হয়েছে৷ বিহারের লালুপ্রসাদ থেকে তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, কেউই ব্যতিক্রম নন৷ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের সাজাও হয়েছে৷ গুজরাট দাঙ্গার তদন্তের ক্ষেত্রেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহকে জেরা করেছে সিবিআই৷ কিন্তু তাঁরা সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করেছেন৷ মমতা ব্যানার্জিরও উচিত তাই করা৷
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সাংসদ এবং কেন্দ্রের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় টুইট করে দাবি তুলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের গুন্ডামি রুখতে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হোক৷ মমতা তাঁর দুর্নীতিগ্রস্ত, কলঙ্কিত সহযোগীদের আড়াল করতেই এই সাংবিধানিক সংকট তৈরি করেছেন৷
রাজ্যের বিজেপি নেত্রী রূপা গাঙ্গুলি টুইট করেন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে সিবিআই জেরা করতে চেয়েছিল৷ তা আটকাতেই মমতা ব্যানার্জি সর্বশক্তি দিয়ে দেশের সাংবিধানিক চেতনা এবং বুনটকে এভাবে নষ্ট করতে চাইছেন৷ এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া কেন? মমতা কী লুকোতে চাইছেন?
মমতা ব্যানার্জি রবিবার রাতে তাঁর ধর্না থেকেই দলীয় কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সোমবার রাজ্যজুড়ে কেন্দ্র সরকারের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করতে৷ তার প্রতিক্রিয়ায় এদিন দুপুর থেকে পথে নেমেছেন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা৷