চিটফান্ড কাণ্ডে ধৃত তৃণমূল সাংসদ
৪ জানুয়ারি ২০১৭পশ্চিমবঙ্গে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের যোগ কিছুতেই আর ছাড়ছে না৷ এর আগে সারদা চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তের সূত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই গ্রেপ্তার করেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের ২ জন রাজ্যসভা সাংসদ এবং একজন মন্ত্রীকে৷ এবার দ্বিতীয় একটি চিটফান্ড রোজভ্যালির তদন্তে প্রথমে গ্রেপ্তার হলেন তৃণমূল সাংসদ, অভিনেতা তাপস পাল এবং তার দু'দিন পরেই আরেক সাংসদ সুদীপ ব্যানার্জি৷ তাঁকে সিবিআই সমন পাঠিয়েছিল আগেই৷ মঙ্গলবার সুদীপ যান সিবিআই দপ্তরে৷ টানা চার ঘণ্টা তাঁকে জেরা করার পর, মূলত তদন্তে অসহযোগিতার কারণে সুদীপকে হেফাজতে নিল সিবিআই৷ তাপস পালের মতো সুদীপের বিরুদ্ধেও মোটামুটি একই অভিযোগ৷ রাজনৈতিক নেতা এবং নির্বাচিত সাংসদ হিসেবে নিজের পদমর্যাদা, ক্ষমতা এবং প্রভাবের অপব্যবহার করে চিটফান্ডের অবৈধ ব্যবসার সুবিধা করে দেওয়া৷ রোজভ্যালির বিরুদ্ধে বাংলা, বিহার এবং ওড়িশা থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা তোলার অভিযোগ, যে টাকা বেআইনিভাবে লগ্নি হয়েছিল হোটেল ব্যবসায়, খুচরো বিপণনে এবং সিনেমা প্রযোজনায়৷
অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য পরিচিত, রোজভ্যালি'র মালিক, শিল্পোদ্যোগী গৌতম কুন্ডু অনেকদিন ধরেই জেলবন্দি৷ তাঁকে জেরা করে সিবিআই যা তথ্য পেয়েছে, তার ভিত্তিতেই এবার এক এক করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেই প্রভাবশালীদের, যাদের বিরুদ্ধে চিটফান্ড ব্যবসাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দেওয়ার অভিযোগ৷ এর পাশাপাশি রোজভ্যালি থেকে নিয়মিত আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাংসদ সুদীপ ব্যানার্জির বিরুদ্ধে৷ সাংসদ তাপস পালের বিরুদ্ধেও নিয়মিত টাকা নেওয়ার অভিযোগ এনেছে সিবিআই৷ এবং এঁদের দুজনের বিরুদ্ধেই সত্য গোপন করা আর তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে৷
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কিন্তু মনে করছেন, যেহেতু নোট বাতিলবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে তাঁর দল, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিশোধ নিচ্ছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার৷ এর আগেও মমতা একই অভিযোগ তুলেছেন৷ মঙ্গলবার সুদীপ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মমতা৷
রোজভ্যালি চিটফান্ডের সঙ্গে বিজেপির সাংসদ, গায়ক সুপ্রিয় বড়াল, ওরফে বাবুল সুপ্রিয়র যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ৷ তৃণমূল নেত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, যদি চিটফান্ড তদন্তই মুখ্য হয়, কেন বাবুল সুপ্রিয়কে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? কেনই বা সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী বা মহম্মদ সেলিমকে ধরা হচ্ছে না, যাঁদের সঙ্গে রোজভ্যালির মালিক গৌতম কুন্ডুর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে শোনা যায়৷ সর্বোপরি, পশ্চিমবঙ্গে চিটফান্ড ব্যবসার শুরু সেই '৮০-র দশকে, যখন রাজ্যে ক্ষমতায় বামফ্রন্ট৷ মমতার ক্ষোভ, কেন সেই সময় থেকে তদন্ত শুরু হবে না?
কিন্তু সমস্যা দুটি জায়গায়৷ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের আমলে চিটফান্ড ব্যবসার শুরু হলেও তা ফুলেফেঁপে ওঠে সেই বাম জমানার শেষ দু'বছরে এবং তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার শুরুর তিন বছরে৷ এটা সিবিআইয়ের তদন্তে রীতিমত তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে একাধিকবার বলা হয়েছে৷ আর দ্বিতীয়ত, বাম নেতারা বহুবার প্রকাশ্যে বলেছেন, তাঁদের কেউ চিটফান্ডের অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন প্রমাণ হলে, আইনত যে শাস্তি প্রাপ্য, তাঁরা নিতে তৈরি৷ কিন্তু এত বছরে সেরকম কোনও প্রমাণ তদন্তকারী সংস্থাগুলির হাতে আসেনি, যার জোরে বাম নেতাদের অভিযুক্ত করা যায়৷ বরং বারবারই উঠে আসছে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম৷ এঁদের মধ্যে এক রাজ্যসভার সাংসদ, সাংবাদিক কুনাল ঘোষ দীর্ঘদিন জেলবন্দি থাকার পর সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন৷ আরেক দাপুটে তৃণমূল নেতা, রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রেরও একই দশা হয়েছিল৷ জামিন পেলেও আদালতের বেঁধে দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এখনও নিজের বাড়ি ফিরতে পারেননি মদন৷ কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এঁদেরকে এতদিন জেলে আটক রাখা সিবিআই বা কোনো তদন্তকারী সংস্থা, কিংবা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ এখানেই বাম-বিজেপি যোগসাজশ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা উঠছে, যা কিন্তু ধোপে টিকছে না৷
তবে তৃণমূল কংগ্রেসের রাগ গিয়ে পড়েছে বিজেপির ওপর৷ মঙ্গলবার সুদীপ ব্যানার্জির গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কর্মীরা হাঙ্গামা করেন মধ্য কলকাতায় বিজেপির রাজ্য সদর দপ্তরের সামনে৷ ভাঙচুর হয়, মারধর করা হয় সেখানে উপস্থিত বিজেপি কর্মীদের৷ এরপর বিজেপিও শক্তি বাড়িয়ে ফিরে আসে পাল্টা হামলা চালাতে, বিরাট পুলিশ বাহিনী নামে পরিস্থিতি সামাল দিতে, দীর্ঘক্ষণ বন্ধ রাখতে হয় কলকাতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার একাংশ৷ বুধবার সকালেও তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সেই রোষ কমেনি৷ হামলা হয় এক বিজেপি নেতার বাড়িতে৷ এদিকে দলের নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও ঘোষণা করেছেন, তাপস পাল এবং সুদীপ ব্যানার্জি, দলের দুই সাংসদের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ, ধর্না চলবে৷ সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আগামী কিছু দিন রাজনৈতিক অশান্তি বাড়বে বই কমবে না৷