সাইবার নিরাপত্তা বিলেও বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ‘সুযোগ’
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩এটা নিয়েই ছিল সাংবাদিকদের প্রধান আপত্তি। এভাবে বিলটি পাশ হলেও এটাকে কালো আইনই বলছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘সাংবাদিকদের সব কথাই রাখা হয়েছে। এখন ৪২ ধারা নিয়ে যেটা বলা হচ্ছে, সাংবাদিকরা এটা বুঝতে পারলে তাদের আর কোনো আপত্তি থাকবে না।’’
সাইবার নিরাপত্তা বিল থেকে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাদ দেওয়াসহ কিছু বিষয় সংশোধন করা হয়েছে। তবে সংশোধন করা বিষয়গুলো মূলত শব্দগত পরিবর্তন। এর বাইরে বিলের একটি ধারা বাদ দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা বিলের কয়েকটি ধারা সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত থেকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা বাতিলের দাবি জানান। তবে কমিটি এই ধারা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারায় এই বিধান ছিল। এখন সাইবার নিরাপত্তা বিলের ৪২ ধারায় এই বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সাইবার নিরাপত্তা বিল সংসদে তোলা হয়। এরপর বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। মাত্র একটি বৈঠক করেই সংসদীয় কমিটি তাদের রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। আগামী রবিবার বা সোমবার চূড়ান্ত রিপোর্ট সংসদে তোলা হবে বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির।
মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পরদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিলটি সংসদীয় কমিটিতে গেলে সেখানে অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সংসদীয় কমিটির আমন্ত্রণে শুধু সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক অংশ নেওয়া সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কমিটি কিছু বিষয়ে সংশোধনী এনেছে। আমাদের সুপারিশ থেকে যেগুলো রেখেছে তার মধ্যে ৮ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রতীয়মান হলেই আগে মামলা করা যেতো, সেটা সংশোধন হয়ে যেটা হলো, তারা যাচাই বাছাই ও তদন্ত সাপেক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিলের ২১ ধারায় শব্দগত পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছিল। আমরা বলেছি, এতে গঠনমূলক সমালোচনার সুযোগও বন্ধ হয়ে যাবে। সেখানে ‘প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা'র বদলে ‘বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক' প্রচারণা প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে এখানে আমরা একটা পরিস্কার ব্যাখা পেলাম।”
জনাব বুলবুল বলেন, ‘‘ধারা-২৯-এ বলা আছে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ। এটা আমরা বাতিল করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু এটা বাতিল করা হয়নি। তবে যেটা বলা হয়েছে, এটা শুধু রাখা হয়েছে। এর সংজ্ঞা ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি অনুযায়ী হবে। পাশাপাশি আমাদের প্রস্তাব অনুযায়ী ৩২ নম্বর ধারাটি পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এই ধারায় অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছিল। ডিজিটাল মাধ্যমে কেউ অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টভুক্ত অপরাধ করলে তার সাজার বিধান করতে এটি যুক্ত করা হয়েছিল। আমরা আরেকটা প্রস্তাব করেছিলাম, কেউ হয়রানিমূলক মামলা করলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এটা এই কারণে আমরা বলেছিলাম যে, একজন সাংবাদিক ঢাকায় একটা রিপোর্ট করলেন, অথচ তার বিরুদ্ধে সারাদেশে মামলা হলো। পরে দেখা গেল মামলাটি সঠিক নয়। এটা আইনে রাখা হবে। এতে মামলার সংখ্যা কমবে বলে আমরা মনে করছি।’’
বিনা পরোয়ানায় বাড়িতে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের সুযোগের বিষয়টি থাকছে কিনা জানতে চাইলে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, "৪২ নম্বর ধারাটি (বিনা পরোয়ানা তল্লাশি ও গ্রেপ্তার) আমরা বাতিল করতে বলেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল, সাংবাদিককে সরাসরি গ্রেপ্তার না করে সমন জারি করতে। কিন্তু এখানে তারা সামান্য সংশোধন করেছেন। আইনে সাব-ইন্সপেক্টরের নীচে নহেন এমন কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেওয়া ছিল। এখন সেখানে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমাদের অনেক দাবিই মানা হয়নি, বিশেষ করে ৪২ নম্বর ধারাটা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ। এই কারণে আইসিটি আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মিসইউজ বা অ্যাবিউজ হয়েছে। নতুন আইনেও সেই জায়গাটা থাকল বলেই আমি মনে করছি।”
বৃহস্পতিবারের বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে সাইবার নিরাপত্তা বিলের ওপর আলোচনা শেষে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশোধিত, সংযোজিত ও পরিমার্জিত আকারে সংসদে প্রতিবেদন উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আইনটির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনেও কার্যত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল বিষয়বস্তু বহাল রাখা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হলেও অপরাধের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। তাই মানুষকে হয়রানি করার সুযোগ থেকেই যাবে। বিলটি সংসদে তোলার সময় আপত্তি জানিয়ে জাতীয় পার্টির সদস্য ফখরুল ইমাম গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে ১৪ দফা দাবি জানিয়ে বলেছিলেন, কিছু ক্ষেত্রে সাজা কমানো হলেও আগের আইনটির সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংসদীয় কমিটি যেটা চূড়ান্ত করেছে সেটা আমরা এখনও দেখিনি। সংবাদমাধ্যমে এর কিছুটা এসেছে। এখানে আসলে কিছুটা লোক দেখানোর জন্য করা হয়েছে। এটি উদ্বেগজনক। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা আইন একদিনের মধ্যে সংসদীয় কমিটি এটা চূড়ান্ত করবে এটা বিরল দৃষ্টান্ত। অংশীজনদের পাশ কাটিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করা হয়েছে। আমরা যেটা দেখছি, এর শুধু খোলসটা পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের নির্বতনমূলক ধারাগুলো রয়েই গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা কমানো হয়েছে। এখন আইনটি যদি এভাবেই হয় তাহলে এটি কালো আইন ছাড়া আর কিছুই হবে না।”
শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে টিআইবি জানিয়েছে, ‘‘খসড়া সিএসএ বিল-২০২৩' বিলে দক্ষতা ও সক্ষমতাকে বিবেচনা না করে এবং বিচারিক নজরদারি ব্যাতিরেকে অপরাধ তদন্ত এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশকে ঢালাও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রয়োজ্য ক্ষেত্রে বিচারিক নজরদারির যে সক্ষমতা দরকার, তা আছে কি-না, তা বিবেচনা করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বাদ দিয়ে অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে, যা বাস্তবে যে কৌশলে সাংবিধানিক অধিকারকে অপরাধ হিসেবে পরিগণিত করা, তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
টিআইবি সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমসহ সকল অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে খসড়া সিএসএ বিল-২০২৩ ঢেলে সাজাতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহের কথা জানিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের কয়েক শত লেখা সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এএফপির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব লেখকের অনেকে ভুয়া পরিচয়, ছবি এবং নাম ব্যবহার করেছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে এসব লেখা ব্যবহার করে গুজবভিত্তিক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা সিনহুয়া, ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের সাউথ এশিয়া ব্রিফসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কথিত বিশেষজ্ঞদের একটি দল নিয়মিত এসব মতামত লিখছেন, যারা বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত বলছেন। কেউ কেউ নিজের পরিচয়ের সঙ্গে অন্যের ছবি ব্যবহার করছেন। আবার কখনো কখনো প্রকৃত বিশ্লেষকদের নামে ভুয়া মন্তব্য প্রচার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রতিবেদনটি আমি দেখেছি। তবে এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। না জেনে মন্তব্য করা উচিত নয়। ফলে এখনই আমি কোন মন্তব্য করতে চাইছি না।”