‘‘সরকার যতটুকু দড়ি ছাড়ে আমলারা ততদূরই যায়’’
২৭ আগস্ট ২০২১ডয়চে ভেলে : বর্তমানে কাজ করতে গিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা কতটা রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ছেন?
আবু আলম মো. শহীদ খান: প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে যেসব গণকর্মচারী কাজ করেন , তারা সব সময় চাপের মুখে থাকেন৷ তারা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেন, জনসেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেন৷ যেমন ধরেন কেউ জমি দখল করে রেখেছে, সেটা উদ্ধার করতে গেলে প্রভাবশালীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তখন তারা গণকর্মচারীদের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেন, যেটা অতীতেও করেছেন৷ এই প্রভাবশালীদের মধ্যে প্রথমেই রাজনীতিবিদ, তারপর ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ আরো অনেকেই আছেন৷ এই যে চাপ সৃষ্টি বা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং তাদের উপর খড়গহস্ত হওয়া, তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা, ঘেরাও করা, বাসা আক্রমণ করা এই ধরনের ঘটনা বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে৷ এটা খুবই উদ্বেগজনক৷
আমলাদের রাজনীতিক দায় থাকা উচিত কি?
আমলাদের তো রাজনৈতিক দায় নেই৷ কারণ তারা তো রাজনীতি করে না৷ বিধিবিধান অনুসারে গণকর্মচারীরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন না৷ এমনকি রাজনৈতিক সভা সমাবেশে যোগ দিতে পারবেন না৷ সেটা করলে তো তারা অপরাধ করবেন৷
আমরা অনেক সময় দেখছি, প্রশাসনের কর্মকর্তারা অতীতের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করছেন৷ এই পরিচয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
এই পরিচয় উল্লেখ করা অনৈতিক৷ কোন কোন ক্ষেত্রে এটা অপরাধের পর্যায়েও পড়ে৷ আমরা তো ছাত্রজীবনে অনেকেই ছাত্র বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি৷ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এই যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা পরে মাঠ প্রশাসনে জনগণের সঙ্গে কাজ করতে উপকারে আসে, এই কাজটা তখন সহজ হয়ে যায়৷ কীভাবে মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়, কীভাবে সংগঠন তৈরি করতে হয় সেই অভিজ্ঞতা তার থাকে৷ কিন্তু তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রশাসনে কাজ করার সময় তিনি যদি সামনে নিয়ে আসেন তাহলে সেটা হবে অনৈতিক৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা অপরাধ হতে পারে৷ আমাদের যে তিনটা বিভাগ আছে, আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ তারা প্রত্যেকেই কিন্তু পৃথকভাবে কাজ করেন৷ আরেকটি কারণে আপনি পরিচয় দিতে পারেন না, আপনি ধরেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা থানার পুলিশ কর্মকর্তা বা যে পর্যায়ে কাজ করেন, আপনি তো সকল জনগণের জন্য কাজ করছেন৷ তার মনে আপনি যদি রাজনৈতিক পরিচয় দেন তখন তো বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকজন মনে করবেন তারা আপনার কাছে ন্যায়বিচার পাবেন না৷ সেটা অল্প সংখ্যক লোক হতে পারে বা অনেক বেশি সংখ্যক মানুষও কিন্তু নিজেদের বঞ্চিত মনে করতে পারেন৷ এটা প্রশাসনের জন্য ভালো নয়৷ আর এই ধরনের পরিচয় মূলত সুবিধা নেওয়ার জন্যই দেওয়া হয়৷
বরিশালের ইউএনওকে আমরা দেখলাম উনি নিজের অবস্থান ব্যাখা করতে গিয়ে আগে ছাত্রলীগ করতেন বলে দাবি করলেন৷ একজন ওসিকে দেখলাম রাজনৈতিক সমাবেশে দলীয় শ্লোগান দিলেন৷ এটার প্রয়োজন পড়ে কেন?
এটার কোন প্রয়োজন নেই৷ আমাদের দেশে কিন্তু হাজার হাজার কর্মকর্তা আছেন তারা এসব না করেই করেই চাকরি করছেন৷ এই ঘটনাগুলো এক বা দুই পারসেন্টের ক্ষেত্রে৷ এরা অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্যই এসব করেন৷ বরিশালের ইউএনও যদি এটা বলে থাকেন, তাহলে হয়ত তিনি এত চাপের মুখে ছিলেন যে তারও একটা পরিচয় ছিল সেটা বলার চেষ্টা করেছেন৷ এটা তার বলার কোন দরকার ছিল না৷ কিন্তু রাজনৈতিক দলের সমাবেশে যোগ দিয়ে কারো পক্ষে কাজ করতে বলা বা কাউকে জিতিয়ে দিতে বলা সেটা কোনভাবেই আইনসিদ্ধ নয়৷ বরং আইন বিরুদ্ধ৷
অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার বিচ্যুতি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে পূর্বের রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হচ্ছে৷ এটা কেন হচ্ছে?
এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে৷ এটা উচিৎ না৷ প্রশাসনে যারা যোগ দেন তারা তো বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে আসেন৷ তাদের পরীক্ষা-ভাইবা হওয়ার পর কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়৷ সেখানে দেখা হয় তিনি কোন ক্রিমিনাল এ্যাক্টিভিটিজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি-না৷ এখন যে ভেরিফিকেশন সেটা অনেক বেশি রাজনৈতিক৷ সেটা আমি ঠিক মনে করি না৷
বিসিএস পরীক্ষার পর চাকরিতে যোগদানের আগে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়?
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় কি-না এমন অভিযোগ আছে৷ অনেককে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তারা বিরোধী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য বলে৷ এনএসআই বা পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে৷ আসলে তো এই প্রতিবেদনগুলো নেওয়া হয় তিনি আগে কোন ফৌজদারি অপরাধ করেছেন কি-না৷ তার বিরুদ্ধে কোন মামলা মোকদ্দমা আছে কি-না তা জানতে৷ কিন্তু এটা দেখার বিষয় না, যে তার বাবা কোন দল করতেন বা তিনি কোন ছাত্র সংগঠন করতেন৷ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এগুলো নাকি এখন দেখা হয়৷ এটা অন্যায়৷ এটা করা ঠিক না৷ বর্তমান শাসকদলই যে এমন করছে তা কিন্তু নয়৷ আগেও এমনটা করা হয়েছে৷ জোট সরকারের সময় আমরা দেখেছি, শুধু মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে কাউকে চাকরি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল৷ এটা শুধু অন্যায় না, সংবিধান বিরুদ্ধ৷
প্রশাসনের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠা অনিয়ম বা দুর্নীতির তদন্ত অনুমতি ছাড়া বাইরের কোন সংস্থা করতে পারে না৷ এতে কি কর্মকর্তারা অনেক বেশি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছেন কি-না?
এর দুইটা দিক আছে৷ আমরা যদি নাম্বারটা বিবেচনা করি, কতজনের এই সুযোগ আছে স্বেচ্ছাচারী হয়ে যাওয়ার৷ আসলে সুযোগ নেই৷ আমাদের ১৭ থেকে ১৯ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা৷ এটা সারা বিশ্বেই আছেই যে, এমনকি বিচার বিভাগের ক্ষেত্রেও তারা ভালো মনে যে কাজটা করবেন সেটার জন্য তার বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল অভিযোগ আনা যাবে না৷ যেমন ধরেন বরিশালে গুলি ছুড়ল সেখানে কয়েকজন আহত হলেন৷ এই গুলি চালানোর ব্যাপারে এক্সিকিউটিভ ইনকোয়ারি হবে৷ তখন যদি দেখা যায়, এটা অন্যায় হয়েছে তাহলে কিন্তু তিনি বিচারের আওতায় আসবেন৷ কিন্তু তার আগে তার বিরুদ্ধে কেউ মামলা করবে এবং বিচার শুরু হবে, সেই কারণেই এই সুরক্ষাটা দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু একজন সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী মার্ডার, রেপ বা এই ধরনের কোন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তাহলে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোন বাধা নেই৷ এইটা দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র অধিক্ষেত্রে৷ যেমন বালুমহলে কোন একটা গোলমাল হল বা উচ্ছেদে গিয়ে কোন ঝামেলা হল সেই সব ক্ষেত্রে৷ আর দুদুকের ক্ষেত্রে তদন্ত করতে বাধা নেই৷ শুধুমাত্র চার্জশিট দিতে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে৷
অনেক সময় আমরা দেখি, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজনীতিকদের কোন ঝামেলা হওয়ার পর সমঝোতা হয়৷ কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ সংগঠিত হয়, মামলাও হয়, সেখানে কী সমঝোতার সুযোগ থাকে?
আমাদের একটা তালিকা আছে৷ ওই তালিকার মধ্যেই থাকতে হবে৷ আমাদের পেনাল কোডে দু'টি জিনিস লেখা আছে, একটা আপসযোগ্য, আরেকটা আপসযোগ্য নয়৷ যেটা আপসযোগ্য নয়, সেটাতে কিন্তু আপনি আপস করতে পারবেন না৷ সেটার তদন্ত হবে এবং অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে৷
মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেটা আছে সেটা কি পর্যাপ্ত?
যারা প্রভাবশালী আছেন তারা তো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেনই৷ এটার চাপ সবসময় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপর থাকে৷ শুধু প্রশাসনে যারা কাজ করেন তাদের উপরই যে চাপ আসে তা কিন্তু নয়৷ বর্তমানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপর চড়াও হওয়ার মাত্রাটা বেড়ে গেছে৷ এই কারণে আনসার গার্ড দেওয়া হয়েছে৷ কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই কিন্তু ফুলপ্রুফ না৷ তাদের নিরাপত্তাটা আসলে জনগণ দেবে৷ কাজটা তারা জনগণের সঙ্গে করেন৷ তিনি ভালো কাজ করলে জনগনই তার নিরাপত্তা দেবে৷ সবসময় তো তিনি পুলিশ-আনসার নিয়ে ঘুরতে পারবেন না৷ এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন আনতে হবে৷ তাদের মনে করতে হবে, গণকর্মচারীদের কাজে সহায়তা দেওয়াও তাদের একটা কাজ৷ এই দায়িত্ব বোধটা যতক্ষণ জাগ্রত না হবে, ততক্ষণ পুলিশ-আনসার দিয়েও তো ঝামেলা মুক্ত হতে পারবেন না৷
বর্তমান সময়ে আমলারা কী একটু বেশি ক্ষমতাবান হয়ে পড়েছেন কি-না? আপনি কী মনে করেন?
আমি ঢালাওভাবে এটা মনে করি না৷ তবে কোন কোন আমলা নিশ্চয় ক্ষমতাবান৷ আমাদের বিসিএস সার্ভিস অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এসোসিয়েশনের বিবৃতিটা যদি আমরা দেখি, সেখানে সভাপতি যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, সেটা অবশ্যই যৌক্তিক ছিল না৷ অনাকাঙ্খিত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে৷ একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সরকার চালায় কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা এবং শাসকদল৷ গণকর্মচারীরা সরকার চালায় না৷ এখন সরকার গণকর্মচারীদের যতটুকু দড়ি ছাড়বে তারা ততদূরই যেতে পারবে৷ বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, ছাগল নাচে খুটার জোড়ে৷ আপনি খুটা থেকে দড়িটা যতদূর দেবেন সে ততদূর পর্যন্ত ঘাস খেতে পারবে৷ আপনাকে তো ততদূর পর্যন্ত তাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে যেন ধান ক্ষেত সে না খেতে পারে৷ এটা যারা রাষ্ট্র চালান তাদের দায়িত্ব৷ আইনসভা এই কাজটা ঠিকমতো না করতে পারলে গণকর্মচারীরা অবশ্যই আপারহ্যান্ড নেবে৷ কেউ যদি সীমা লঙঘন করে তাহলে তাকে তো শাস্তি দিতে হবে৷ এখন আপনি যদি শাস্তি না দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকেন তাহলে তারা তো আপারহ্যান্ড নেবে, এতে তাদের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই৷