1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সবার জন্য সুপেয় পানি কতদূর?

১৩ মে ২০১৯

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭ টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে, ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য যা নিশ্চিত করতে হবে৷ এজন্য ১৩৫ বিলিয়ন টাকা খরচ করতে হবে বলে জানিয়েছেন একজন বিশেষজ্ঞ৷

https://p.dw.com/p/3IKgZ
Weltwassertag
ছবি: picture-alliance/AFP Creative

বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী,  বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো-না-কোনো উৎস রয়েছে৷ কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়৷ নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগামের সর্বশেষ হিসেবে তা শতকরা ৮৭ ভাগ বলা হচ্ছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর রুর‌্যাল পুওর (ডরপ)-এর রিসার্চ, প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান৷ তিনি স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার ফর অল-এর দক্ষিণ এশিয়ার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য৷ এই হিসাব আমলে নিলেও এখনবো ১৩ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না৷ তবে পানির দূষন হিসেব করলে ৪৪ ভাগ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানির আওতার বাইরে আছেন৷

কেন পানির উৎসগুলো নিরাপদ নয়

প্রতিবেদনগুলোতে সুপেয় পানির হিসাব করা হয়েছে উৎস বিবেচনা করে৷ কিন্তু সেগুলোও এখন দূষিত হয়ে পড়ছে৷ দেশের ১৩ ভাগ পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে৷ কারও কারও হিসাবে তা আবার ২৬ ভাগের মতো৷

গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, পাইপলাইনের পানির ৮০ ভাগেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে৷ পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ ৩৮ শতাংশ টিউবওয়লের পানিতেও এই ক্ষতকির অনুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে৷ পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটরিয়াকে দায়ী করা হয়৷

এজন্য যথাযথ স্যানিটেশন সুবিধা না থাকাও একটি বড় কারণ৷ ঢাকায় মাত্র ২০ ভাগ স্যুয়েরেজ পাইপ লাইন রয়েছে, বাকিটা খোলা৷ আবার সারাদেশে পয়ঃবর্জ্যের মাত্র ২ ভাগ ট্রিটমেন্ট করা হয়৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বাকি বর্জ্য মূলত পানিতেই মিশে যাচ্ছে৷ ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রামস অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর মো. লিয়াকত আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ ঢাকার পাগলায় একটি মাত্র পয়:বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে৷ সেটাও কাজ করেনা৷ তাহলে এই বর্জ্য কোথায় যায় ? বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পানিতে মেশে৷''

‘বাংলাদেশের ৫৬ ভাগের বেশি মানুষ নিরfপদ পানি পচ্ছেন না’

এছাড়া দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে লবনাক্ততার কারণেও পানি পানের অযোগ্য হচ্ছে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এসব এলাকার এক তৃতীয়াংশ গৃহস্থালি পানি দূষিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে৷ মো. লিয়াকত আলী বলেন,‘‘যেভাবেই হিসাব করা হোক না কেন এখন বাংলাদেশের ৫৬ ভগের বেশি মানুষ সুপেয়  বা নিরপদ পানি পচ্ছেন না৷ কারন আর্সেনিক  এবং অন্যান্য বায়োলজিক্যাল কন্টেমিনেশন, প্রাপ্য পানি থেকে বাদ দিয়ে নিরাপদ পানির হিসাব করতে হয়৷ জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগামের ২০১৮ সালের রিপোর্টও তাই বলছে৷''

ঢাকায় সুপেয় পানি

ঢাকাবাসীর জন্য পাইপ লাইনে ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তারমধ্যে ৭৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ, বাকি পানি আসে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে৷ ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে৷ যা অদূর ভবিষ্যতে ঢাকায় পানির বড় সংকট তৈরি করবে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের৷ যদিও ২০২১ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ২৫ ভাগের নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াসার৷

রাজধানীতে এখন ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের বসবাস৷ এরমধ্যে ২০ ভাগ মানুষ বস্তিতে থাকেন৷ তাদের ৭০ ভাগের পানির কোনো বৈধ উৎস নাই৷  ঢাকায় গড়ে মানুষের প্রতিদিন পানির চাহিদা ১৪০ লিটার হলেও বস্তিবাসীরা পান মাত্র ২০ লিটার৷

গত ১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকায় ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংস্থাটির পানি পানের উপযোগী করে৷ এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সিদ্ধ করে পান করেন৷ পানি পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়৷ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৫১ শতাংশ গ্রাহক সরবরাহকৃত পানিকে অপরিস্কার এবং ৪১ শতাংশ গ্রাহক দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করেছেন৷

নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া যায়৷ ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা বলেন,‘‘ওয়াসার পানি ফুটিয়ে ছাড়া পান করা অসম্ভব৷ কখনো কখনো তা পানের পুরোপুরি অযোগ্য থাকে৷ পানিতে দুর্গন্ধ থাকে৷ মুখে দেয়া যায়না৷ কেরোসিন তেলের মত রঙ হয়৷ আবার এই পানি ব্যবহার করলে শরীর চুলকায়৷''

তারা আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এই পানির কারণেই নানা ধরণের পেটের পীড়া হয়৷ পানি খেলে বমি বমি ভাব হয়৷ বাচ্চারা খেতেই পারেনা৷''

টিআইবি'র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ২০ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলন করে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়, বিশুদ্ধ৷ একে ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷'' এমডির এই কথার জবাব দিতে তাঁকে ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত খাওয়াতে গিয়ে আলোচনায় আসেন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান৷ ২৩ এপ্রিল তিনি ওয়াসা ভবনে গিয়ে শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি অফিসে না থাকায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ যারা ছিলেন তারাও খাননি৷

ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন ডয়চে ভেলের কাছে দাবী করেন, ‘‘উৎসে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ৷ আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পানি বিশুদ্ধ করি৷ এখন কেউ যদি চোরাই লাইন নেন৷ কারুর পানি রিজার্ভারে যদি  সমস্যা থাকে, দূষিত পদার্থ থাকে, যদি নিয়মিত পরিস্কার না করে সে দায়িত্ব কে নেবে?''

‘সবাইকে নিরাপদ পানি দিতে হলে খরচ করতে হবে ১৩৫ বিলিয়ন টাকা’

পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইমামুল হক বলেন,‘‘পরিশোধন পর্যায়ে পানি ঠিকই থাকে৷ উৎসে পানির মান বজায় থাকে৷ কিন্তু সমস্যা  হয় সরবরাহ লাইনে৷ এই লাইনগুলো খুবই খারাপ৷ ঢাকা শহরে যত ময়লা আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ আছে তা সব এই পাইপ লাইনে ঢোকে৷ কিন্তু ওয়াসার দায়িত্ব হলো গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পৌছে দেয়া সেটা তারা করে না৷ তাই পানিতে শুধু ই-কোলাই কেন আরো অনেক জীবানু এবং দূষিত পদার্থ থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর৷''

ঢাকার ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মানুষের জন্য প্রতিদিন ওয়াসা ২৩৯ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহ করে৷ তাদের প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার পাইপ লাইনের মধ্যে ৩৬ হাজার কিলোমিটারই পুরনো এবং নিম্নমানের৷  ৮শ'রও বেশি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি তোলে সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ করার জন্য তাদের ৫টি প্ল্যান্ট আছে৷

পানি নিয়ে বৈষম্য

ঢাকা শহরে পানি নিয়ে বস্তিবাসী বা নিম্নবিত্ত মানুষ যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যেও আছে বৈষম্য৷ নিরাপদ পানির জন্য সরকারের মোট বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই শহরের মানুষের জন্য৷ গ্রামের মানুষ পাচ্ছে বাকি ২০ ভাগ৷

৮৩ ভাগ শহুরে মানুষ তাদের হাতের কাছেই নিরাপদ পানির উৎস পায়৷ কিন্তু গ্রামে পায় ৭১ শতাংশ মানুষ৷ অন্যদিকে উপকুলীয় এলাকায় লবনাক্ততার কারণে নিরপদ পানির উৎস কমে যাচ্ছে, এর শিকারও হচ্ছেন মূলত গরীব মানুষ৷

সব মিলিয়ে গড় হিসেবে ৫৬ ভাগ পেলেও নিম্নবিত্ত মানুষের মাত্র ৩৬ ভাগের কাছে নিরাপদ পানি পৌছাচ্ছে৷

নিরাপদ পানির চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদী আছে৷ এর বাইরে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে পুকুর, নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়৷ কিছু কিছু জায়গায় স্বল্পমাত্রায় বৃষ্টির পানি ব্যবহার হয়৷

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে পানির ৪টি দিক নিশ্চিত করতে হবে৷ সেগুলো হল প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা, গুণগত মান এবং পানি পাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা৷ মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে সফল বলা যায়৷ কিন্তু সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে সময় আছে হাতে মাত্র ১১ বছর৷ এই সময়ের মধ্যে আরো ৪৪ শতাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে৷ এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে৷ তাই সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে৷''

নিরাপাদ পানির জন্য এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে৷ গ্রামাঞ্চলে নলকূপ পানির একটি বড় উৎস৷ কিন্তু তাতে আর্সেনিক সমস্যা আছে৷ যোবায়ের হাসান জানান,‘‘সরকার প্রতিটি মৌজায় একটি করে পুকুর খনন বা পুনর্খনন করতে চায় নিরাপদ পানির উৎস হিসেবে৷ আর নলকুপগুলো ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন৷ এর দায়িত্বে আছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর৷ সব মিলিয়ে  পানির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবাইকে নিরাপদ পানি দিতে হলে খরচ করতে হবে ১৩৫ বিলিয়ন টাকা৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য