সব ভালো চাই, নিজে ভালো তো?
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০স্বেচ্ছাসেবার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক কী? নাকি যে-কোনো কিছুতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ টেনে আনা অভ্যেস হয়ে গেছে? এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে৷ এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ব্যবসার পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এই প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিকও নয়৷ তাই একটু ব্যাখ্যা দিয়ে নেই৷
সবারই মনে আছে, কয়েক বছর আগে ঢাকা সিটি দুভাগ হলো৷ নির্বাচনের পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে বসলো ছোট ছোট ডাস্টবিন৷ কিন্তু তাতে কারো কিছু আসলো গেলো না৷ ডাস্টবিনে অনেককে নিজেদের ‘সই পরীক্ষা' করতে দেখেছি৷ যদি আবর্জনা এর ভেতরে পড়লো তো পড়লো, না পড়লে নাই৷ কদিন পর ডাস্টবিনগুলোই হাওয়া হতে লাগলো৷ একসময় ডাস্টবিনের ফ্রেমগুলো পরিণত হলো ফটোফ্রেমে৷
আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু, যার নাম আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই- মুনরবি অমিয় মোহাম্মদ৷ আমাদের বন্ধুদের একটা ঘোরাঘুরির দল রয়েছে, মজা করে যার নাম দিয়েছিলাম ওরা ১১ জন৷ তো এই ১১ জনের মধ্যে অমিয় একটু আলাদা৷ দেশের যে প্রান্তেই আমরা ঘুরতে যাই না কেন অমিয়র কাজ নিজের ব্যবহার করা সব ময়লা-আবর্জনা (এর মধ্যে রয়েছে কলার খোসাও) ব্যাগে ঢোকানো৷ অনেকেই ঠাট্টা-মশকরা করে বলতো, ‘‘মানুষ সংগ্রহ করে স্যুভেনিয়র, আর অমিয় করে আবর্জনা৷'' কিন্তু তাতে অমিয়র কিছু আসতো যেতো না৷ সে বলতো, ‘‘সব ময়লা পরিষ্কার করতে না পারি, আমি তো দেশ নোংরা করায় অংশগ্রহণ করছি না৷''
আজ নির্বাচন এলেই যখন মেয়র প্রার্থীরা ঝাড়ু হাতে নামেন, আমার তখন অমিয়র কথা মনে পড়ে হাসি পায়৷ যখন দেখি আমরাই রিক্সায় যাওয়ার পথে পলিথিনটা-কাগজটা নির্দ্বিধায় রাস্তায় ফেলে দেই, আবার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় সরকারকে-মেয়রকে গালি দেই, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই, আমার অমিয়র কথা মনে পড়ে হাসি পায়৷
আমি গাড়িতে থাকলে কখনো সেটাকে রং সাইডে যেতে দেই না, হর্ন দিতে দেই না৷ অথচ অনেক সাংবাদিক, পুলিশ, নেতা, ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখি নির্দ্বিধায় উলটো পথে গাড়ি চালান৷ ঢাকার যানজট নিয়ে, পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়েও তাদের আপত্তির অন্ত নেই৷ সিগনাল ছাড়া দৌড়ে রাস্তা পেরোতে চাইতাম না বলে কতজন আমার সঙ্গে হাঁটতেও চান না৷ আবার অন্য কোনো ক্ষেত্রে হয়তো দেখা যাবে আমি নিজেও এমন কিছু করছি, যা আসলে কোনোভাবেই করা উচিত নয়৷
শীতকাল চলে গেছে, মশার উপদ্রব বাড়ছে৷ আবার হয়তো ডেঙ্গু আসবে, আতঙ্ক তৈরি হবে৷ কিন্তু আমরা নিজেরাও নিজেদের চারপাশ পরিষ্কার রাখবো না, স্থানীয় সরকারও ‘অনেক কাজ করছি' দেখানোর জন্য নানা তামাশা করবে৷ কিন্তু নিজেকে নিজে বোকা বানিয়ে লাভ কী!
বাংলাদেশে এখন অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে৷ কেউ পথশিশুদের নিয়ে, কেউ পশুদের নিয়ে, আরো নানা কিছু নিয়ে কাজ করেন৷ স্বেচ্ছাসেবা এক ধরনের ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কাজ৷ ফলে এর যেমন স্বীকৃতি মেলা কঠিন, দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়াটাও দুরুহ৷ ফলে যারা পারেন, আমার তাদের দেখে হিংসা হয়৷
কিছুদিন নিজের এক স্বেচ্ছাসেবা সংগঠনে কাজ করে বুঝেছি, প্রচণ্ড একগুঁয়ে না হলে এ কাজ চালানো বেশ কঠিন৷ এতে আপনার দিকে দিকে নাম ছড়িয়ে পড়বে না, নিজের উপার্জিত অর্থ খরচ হবে, সময় ‘নষ্ট' হবে, এমনকি অন্যের টাকা নিজের পকেটে পুরছেন কিনা সে প্রশ্নও উঠবে৷
মুক্তিযুদ্ধের কথায় ফিরে আসি৷ মুক্তিযুদ্ধে যেমন কিছু মানুষ সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ কেউ ট্রেনিং দিয়েছেন, কেউ আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে কাজ করে গেছেন, কেউ আবার গেরিলাদের আশ্রয়, খাদ্য, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন৷ সবার সম্মিলিত এক প্রয়াসে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক৷ কিন্তু সেই স্বাধীন দেশকে সুন্দর করে তুলতে আমরা কী ভূমিকাটা রাখছি?
সব কাজ আমরা করলে সরকার আছে কেন? কথা অনেকটাই সত্য৷ কিন্তু তার চেয়ে বড় সত্য, আমরা কিছু না করলে সরকার কি আমাদের হয়ে সব করে দিতে পারবে? বরং নিজেরা নিজেদের আশপাশ পরিষ্কার রাখি, মশার আবাসস্থল তৈরি হতে না দেই, নিজেদের চারপাশে সভ্য সমাজ গড়ে তুলি, বন্ধুদেরও উৎসাহ দেই৷ তারপর অবশ্যই সরকার এবং দায়িত্বশীলদের চ্যালেঞ্জ জানাই৷
স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে সব অনিয়ম ঠিক করে ফেলা যাবে না, কিন্তু এটা ছাড়া বদলে ফেলার শুরুটা হবে না৷ চলুন বদলাই, নিজেকে সুন্দর করি, চারপাশ সুন্দর করি, দেশটা সুন্দর করি৷ তা না হলে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' শুনে ঢাকার এয়ারপোর্টে নেমেই ভিনদেশিরা হাসবে৷ আমি হাসির পাত্র হতে চাই না৷ আপনি?
প্রিয় পাঠক, আপনি কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷