যার বাড়িতে গেছেন তাকে কেনো এক দশকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেই আলোচনার বদলে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন রাষ্ট্রদূত কেনো সেখানে গেলেন তা নিয়ে৷
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গত ১৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার শাহীনবাগে যেতে যে কোনো আগাম অনুমতির দরকার ছিল না সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন৷
ঢাকার পত্রিকাগুলোকে তিনি বলেছেন, ‘‘স্পর্শকাতর এলাকায় চলাফেরা করতে হলে কূটনীতিকদের অনুমতি নিতে হয়৷ যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ তবে ঢাকার মধ্যে কূটনীতিকদের চলাফেরায় অনুমতি লাগে না৷ তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন৷’’
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সেখানে গিয়ে যে বাংলাদেশের বিচারে কূটনৈতিক কোনো শিষ্টাচার লঙ্ঘন করেননি সেটা সচিবের বক্তব্যেই পরিষ্কার৷ তারপরও কারো কারো সেটা অপছন্দ হতেই পারে৷ এই অপছন্দ নিয়ে আমার দুটো কথা বলার আছে৷
বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম, খুনের অগুণতি ঘটনা নিয়ে গত একযুগ ধরেই ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে৷ দীর্ঘ সময় এই আলোচনা মূলত বাংলাদেশের গণমাধ্যমেই হয়েছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি যে কথিত ‘ক্রসফায়ারগুলো’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার একটি টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক৷
ব়্যাব দাবি করেছিল, ২০১৮ সালে নিরাপত্তা বাহিনীটির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন একরাম৷ কিন্তু এই দাবি যে সঠিক নয় সেটা ঘটনার সময়কার বিভিন্ন অডিও রেকর্ডিং থেকে স্পষ্টই বোঝা গিয়েছিল৷ আর সেই সূত্র ধরে স্থানীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ সরকারপন্থি, সরকারবিরোধী, নিরপেক্ষ সব তকমার সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেল এই সংবাদ প্রকাশ করেছে৷ টকশোতে আলোচনার ঝড় উঠেছে৷
অবশ্য, গণমাধ্যমে বিষয়টি এতবড় করে উঠে আসার পরও ফলাফল ছিল শূন্য৷ সরকারের তরফ থেকে একরাম নিহতের ঘটনার সুবিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ যে বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ সেটিও এই বিষয়ে কোনা সদুত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি৷
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একরাম নিহতের ঘটনা উল্লেখ করে ২০২১ সালে ব়্যাব এবং এর সাত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো তখন আবার অনেককে বিরক্ত হতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ এর মধ্যে বিএনপির তদবির দেখতে পেয়েছেন৷ কেউ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন এই দেশ নিয়ে কথা বলে, ঐ দেশ নিয়ে কথা বলে না, এই ধরনের নানা যুক্তি দিয়ে বিষয়টি হালকা করার চেষ্টা করেছেন৷ অথচ একরামুল হক ছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলেরই একজন সক্রিয় নেতা৷ বিএনপির সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্কও নেই৷ কিন্তু ঘটনাটি যে নিছক ‘ক্রসফায়ার' নয় সেটা প্রমাণ করার যথেষ্ট উপাদান ছিল৷
কার্যত ব়্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে সেই নিষেধাজ্ঞার পর৷ অর্থাৎ যে বাহিনীর জবাবদিহি সরকার নিশ্চিত করতে পারেনি বা করতে চায়নি, সেই বাহিনী কিছুটা জবাবদিহির আওতায় আসে মার্কিন চাপে পড়ে৷
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার যদি সাধারণ জনগণের কথা শুনতো, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আমলে নিতো, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা দেয়ার প্রয়োজন পড়তো না৷ তার অনেক আগেই একরাম নিহতের একটি গ্রহণযোগ্য তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারতো৷ সেটা করা হয়নি৷
একরামুল হককে আমি এখানে একটি উদাহরণ হিসেবে এনেছি৷ এরকম আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছেন রাশেদুল ইসলাম শাহীন৷ গত ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূরের লাশ উদ্ধার হয়৷ শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতির অভিযোগ, ফারদিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তার স্বামীকে ১০ নভেম্বর ‘ক্রসফায়ারে' হত্যা করেছে ব়্যাব৷ ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার সংবাদপত্র প্রকাশ করেছে এই তথ্য৷
অথচ গোয়েন্দা পুলিশ আর র্যাব এখন বলছে ফারদিন নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন৷ মাঝখান থেকে কথিত ‘ক্রসফায়ারে' জীবন গেলো শাহীনের৷ তিনিও ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের একজন কর্মী ছিলেন৷
বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে পাখির মতো মানুষ হত্যার এরকম উদাহরণ অনেক৷ এসব উদাহরণ পত্রিকার পাতাতে দেখা যায়, দেশি বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার গবেষণাতেও উঠে আসে৷ নানারকম সংখ্যার কথা আমরা শুনি, কিন্তু সেই সংখ্যাগুলো ধরে সুষ্ঠু তদন্তের কথা শুনিনা৷ বরং সংখ্যার মারপ্যাচে তথ্য লুকানোর প্রবণতাই দেখা যায় বেশি৷
একজন মানুষ যদি কোনো অপরাধ করেও থাকেন, তাহলেও তাকে ন্যায্য বিচারের মুখোমুখি না করে ‘ক্রসফায়ারের' নামে হত্যা করাটা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন৷ আর এই চর্চা বন্ধ করতে বা ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে গত একযুগে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কোনো চেষ্টাই ফল দেয়নি৷
এর কারণ একটাই, বর্তমান সরকার নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করে৷ দেশের জনগণ, গণমাধ্যম, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ কী ভাবলো সেটা তাদের কাছে নস্যি৷ আর বিরোধী দল বড় করে রাস্তায় নামলে তাদের দমনে প্রয়োজনে সামরিক অস্ত্র এম১৬ রাইফেল ব্যবহারেও যে কার্পণ্য করা হবে না সেই মহড়াতো কিছুদিন আগে ঢাকাতেই দেখা গেলো৷
পরপর দুটি বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা হাসিনা সরকার এখনও যা একটু তোয়াক্কা করে তাহচ্ছে বিদেশি কূটনীতিকদের৷
আর এই কূটনীতিকদের একটি বড় অংশ গত কয়েকমাস ধরে বেশ সরব৷ তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী ব্যবস্থা দেখতে চায়, চায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম, খুনের চর্চার ইতি৷ হাসিনা সরকারের কাছে বিষয়টি বেশ অস্বস্তির৷
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে এক গুম হওয়া বিএনপি নেতার বাসায় যাওয়াটা সেই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে৷ অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ সালে ‘ব়্যাবের সদস্যরা’ তুলে নিয়ে যান বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামকে৷ তার বোন সানজিদা ইসলাম তারপর থেকে ভাইয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরেছেন৷ তারই মতো আরো যাদের প্রিয়জন ‘নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম' হয়েছেন, তাদেরকে নিয়ে গড়া সংগঠন ‘মায়ের ডাক'৷ উদ্দেশ্য, একযোগে প্রিয়জনদের সন্ধান করা৷ এই সংগঠন যারা গুম হওয়ার কথা বলছে, তাদের একটি বড় অংশই বিএনপির নেতাকর্মী৷ তবে, আরো বিভিন্ন দলের গুম হওয়া নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যরা যুক্ত রয়েছেন মায়ের ডাকের সঙ্গে৷
এরকম একটি সংগঠনকে বিএনপিসহ সকল দল এবং সচেতন নাগরিকদের সমর্থন দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি৷ রাজনীতি করা কোনো অপরাধ নয়৷ তবে, একটি দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে এভাবে গুম হওয়া মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন৷
কিন্তু বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো গুমের ঘটনাতেও আমি সরকারের একইরকম অবস্থান দেখি৷ ‘মায়ের ডাক' যারা গুম হয়েছে বলছে, তাদের খুঁজে বের করতে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায় না৷ যদি যেতো তাহলে আজকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের হয়ত সাজিদুল ইসলামের বাসায় গিয়ে গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হতো না৷
সেখানে আবার ‘মায়ের কান্না' নামের আরেক সংগঠন অপ্রীতিকর এক ঘটনা ঘটিয়েছে৷ ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর যেসব সদস্যের ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরি গিয়েছিল, তাদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন এটি৷ ‘মায়ের কান্নার' অনেক সমর্থক, যাদেরকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী বলছে ঢাকার গণমাধ্যম, রাষ্ট্রদূত যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা করে বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস৷ তখন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হলে অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করে ঘটনাস্থলত্যাগ করার চেষ্টা করেন রাষ্ট্রদূত৷ সেসময় তার গাড়িও ঘিরে রেখেছিলেন কিছু ব্যক্তি৷ হঠাৎ করে এভাবে শুধু একজন রাষ্ট্রদূত নয়, যেকাউকে ঘিরে ধরলেই সেই ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়বেন৷
অথচ, ‘মায়ের কান্না' চাইলেই মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাষ্ট্রদূতকে তাদের কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে বা স্মারকলিপি দিতে পারতো৷ সেটাই আনুষ্ঠানিক পথ৷ তা না করে হঠাৎ তার পথরোধ করে উল্টো উস্কানি দেয়া হলো৷
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, মায়ের কান্না নামের কোনো সংগঠন গত কয়েকবছরে একবারও দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি৷
মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ না করেও অতীতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, যার বিচার এখনো হয়নি, সেটা সামনে আনা যেতেই পারে৷ যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই ইস্যুর সুরাহা এতদিনেও করেনি? সেই ঘটনার কি বিচার করার সুযোগ এখন আদৌ আছে? থাকলে করা উচিত বলেই আমার মত৷ প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই বিচার জরুরি৷
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য নতুন আরেক তথ্য দিয়েছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল অবধি বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগের নিখোঁজ নেতাকর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে৷ সেগুলোর তদন্ত হবে৷
এক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটু নড়াচড়া কত ফল বয়ে আনছে দেখুন৷ আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই৷ এই কাজটা আরো অনেক আগে করা উচিত ছিল৷ তবে আরো খুশি হবো যদি তিনি পুরনো ফাইল টানার আগে তার দলের একরামুল হক, এবং রাশেদুল ইসলাম শাহীনের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যুর' নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারেন৷ কিন্তু তিনি কি সেটা পারবেন?