‘শীতকাল খুব অপছন্দ করি'
২২ ডিসেম্বর ২০২৩শেখ মুজিবুল হক। বয়স ৮৬ বছর। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের অধীনে ঢাকার আগারগাঁওয়ে প্রবীণ নিবাসে থাকেন ৩০ বছর। এক সময় ছিলেন একটি কলেজের অধ্যক্ষ। তিন মেয়ে আর এক ছেলের জনক। ছেলে-মেয়েরা সবাই ঢাকাতেই থাকে। সবাই নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তার স্ত্রীও থাকেন ছেলে-মেয়ের সঙ্গে। এক মেয়ে মাঝে মধ্যে দেখতে আসলেও অন্য দুই মেয়ে ও ছেলে আসে না। কিন্তু সম্মান যাওয়ার ভয়ে প্রকাশ করলেন না ছেলে-মেয়েদের পরিচয়। নোংরা রুমে ছেঁড়া কাপড়ে থাকলেও সারাক্ষণ প্রশংসা করলেন ছেলে-মেয়েদের। গল্প বলতে গিয়ে কখনও চোখ ছল ছল করে উঠেছে। অথচ প্রবীণ নিবাসের খরচ বহন করেন নিজের সঞ্চয় থেকেই। ছেলে মেয়েরাও দেয় না কোনো টাকা। ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে শীতের একাল-সেকাল নিয়ে নানা গল্প বললেন। নিজের স্মৃতি হাতড়ে নানা ধরনের পিঠা খাওয়া কথাও জানালেন। ১৯৮১-১৯৮২ সালের শীতকে তিনি আলাদা করে রেখেছেন।
ডয়চে ভেলে : প্রবীণ নিবাসে কতদিন আছেন?
শেখ মুজিবুল হক : ৩০ বছর।
আপনার ছেলে মেয়ে কেউ আছে?
আছে। তারা দেখা করতে আসে। আমার তিন মেয়ে আর এক ছেলে।
এবার শীত কেমন দেখছেন?
ভালো না। খারাপ। আমি শীতকাল খুব অপছন্দ করি।
এবার খারাপ বলছেন কেন?
এখন তো বয়স হয়েছে। সহ্য শক্তিও তো কমে গেছে। এই কারণে ভালো লাগছে না। রৌদ্রে বসে থাকতে ভালো লাগে।
আগে শীত কেমন দেখেছেন?
আগে এর থেকেও বেশি ছিল। একবার মনে আছে, পাঁচ দিন আমি ঘরের বাইরে বের হইনি।
কত সালে এটা?
মনে হয় এটা ১৯৮১ বা ১৯৮২ সাল হবে।
তখন কি অনেক শীত পড়েছিল?
অনেক, অনেক। ওই শীতকালটা অনেক ঠান্ডা ছিল।
শীত বলতে তো পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব। এটা এখন কীভাবে উপভোগ করেন?
এখন কিনে খাই। হোটেলে পাওয়া যায়। আগে বাসাতে তৈরি হতো। এখন তো আর বাসা নেই, প্রবীণ নিবাসে থাকি। এখানে মেয়েরা বিক্রি করে, তাদের কাছ থেকে কিনে খাই।
আপনার প্রবীণ নিবাসে থাকার খরচ কে দেয়?
আমার নিজের সঞ্চয়।
ছেলে মেয়েরা কি দেখতে আসে?
অবশ্যই।
তারা কি খাবার নিয়ে আসে?
আমি খুব ভোজন প্রিয় মানুষ। ওরা পোলাও কোরমা নিয়ে আসে।
শীতের উৎসবটা আগে কীভাবে উপভোগ করেছেন?
খুব ভালো ছিল। মা পিঠা তৈরি করতেন। মজা করে খেতাম।
আপনার স্ত্রী কি বেঁচে আছেন?
আছে।
দেখতে আসেন?
না।
তিনি কোথায় থাকেন?
ছেলে-মেয়েদের সাথে।
তিনি কেন আসেন না?
প্রয়োজন হয় না।
আপনি আগে কী করতেন?
চাকরি করতাম। ঢাকার লালমাটিয়ার আরাফাত ইন্টারন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলাম। তখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন জালাল উদ্দীন। তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল।
এখন তো বয়স হয়েছে। শীতে কতটা সুস্থ থাকতে পারেন?
দেখছো তো, খুব ভালো আছি।
এখানে কি চিকিৎসক আছেন?
আছে। এটা তো মূলত প্রবীণ হাসপাতাল। তার পাশে করা হয়েছে প্রবীণ নিবাস।
ডাক্তার কি আপনাদের নিয়মিত পরীক্ষা করেন?
না। এখানে যারা আছে তারা টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। তারা আমাদের মানুষ মনে করে না। আমাদের পোল্ট্রি মুরগি মনে করে। মনে করে আমরা ফার্মে আছি। তাই আমি কিছু হলে শমরিতা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যাই।
শীত তাহলে আপনার কাছে খুব অপছন্দের?
হ্যাঁ।
শীত নিয়ে কি খারাপ কোন অভিজ্ঞতা আছে, যে কারণে পছন্দ করেন না?
না। এটা জন্মগত। কিছু কিছু মানুষের তো এটা থাকে।
শীত নিয়ে আপনার কোনো ভালো স্মৃতি আছে?
না।
কখনও কোন মেলায় গেছেন বা নৌকা বাইচ দেখতে গেছেন?
গেছি। সেটা সাধারণ মেলা। শীত উপলক্ষে না।
আপনার বাড়ি কোথায়?
যশোর শহরে।
সেখানেই কি বেশি সময় কেটেছে?
না। সেখানে নামকাওয়াস্তে ছিলাম। বাবা আমাদের সব সম্পত্তি ফুফুকে লিখে দিয়েছেন। বোনের কাছে গেছে, হাতে পায়ে ধরে কেঁদেছে। তখন তার মনে গলে যায় আর সবকিছু ফুফুকে লিখে দেয়। সেখানে যে আমাদেরও হক আছে সেটা তিনি ভুলে গেছেন। এ জন্য মা বলতেন তোদের বাবা দাতা হাতেম তাই।
জীবনের বেশিরভাগ সময় কোথায় কেটেছে?
এই প্রবীণো নিবাসে। ৩০ বছর। এর আগে আগে লালমাটিয়ায় ছিলাম।
শীত কি এবার বেশি মনে হচ্ছে?
না। বরং এবারই সবচেয়ে কম। অন্য বছর এর চেয়ে বেশি পড়ে। তবে দেখো, কয়েকদিন আগে ১৬ ডিসেম্বর গেল কোন ধরনের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করল না। আগে বিশেষ দিবসে খাওয়াতো। এখন খাওয়ায় না, কেন জানি না।
শীতের সময় কি এখানে আলাদা কোনো পোশাক দেওয়া হয়?
না। আমরাই ব্যবস্থা করি। নিজের যা আছে তাই।
এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা কেমন?
ভালো। একটা মেয়ে আছে, ও ভালো রান্না করে। আরেকটা মেয়ে বাজার করে। আমরাই টাকা দেই।
আপনার শীতের পোশাক কে দেয়?
আছেই তো।
এগুলো তো ছিঁড়ে গেছে?
এ দিয়েই চলে যাবে।
ছেলে মেয়েরা কী পোশাক আনে?
না। দরকার পড়ে না।
বাইরে বের হলে?
এগুলো পরেই যাই। আমার তো মাফলার আছে।
শীত নিয়ে ছোট বেলার কোনো স্মৃতি আমাদের বলতে পারবেন?
আমার স্কুল জীবন শুরু হয়েছে বরিশালে। আমি বরিশালের মিশনারি স্কুলের সেরা ছাত্র ছিলাম। আমাদের একটা গরু ছিল। সে ১০ সের করে দুধ দিত। আমি দুধ আর সর খেতে খুব পছন্দ করতাম। মোটা সর। স্কুল থেকে দৌঁড়ে আসতাম সর খাওয়ার জন্য। মা রেখে দিতেন। তখন অনেক মেলায় গেছি। তবে শীত বলে যে গেছি তেমন না।
তখনকার সময়ের শীত আর এখনকার শীতের মধ্যে পার্থক্য কি?
আমি কখনই শীতকাল পছন্দ করি না। মাঘের শীত বাঘের গায় বলে না। ওরকম আর কি। একটাই খারাপ অভিজ্ঞতা। ওই যে পাঁচ দিন ঘর থেকে বের হইনি। রোদও ছিল না। আমি বাস্তবাতাকে মেনে নিতে শিখেছি। জানি মেনে নিতে হবে। আমি কিন্তু ডাবল এমএ। ইংলিশেও করেছি। আবার চারুকলাতেও করেছি। এই যে প্যারেন্টিংটা এটা আমার নিজের করা।
এখন কীভাবে সময় কাটে?
শুয়ে-বসে।
বই পড়েন?
না। এক্কেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছি। পেপারও পড়ি না।
ছেলে মেয়েরা কি কখনও পিঠা নিয়ে আসে?
না। ওরা জানে আমি এখান থেকে কিনে খায়। চিতাই পিঠা আমার খুব অপছন্দ। আর সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, ঝোলা গুড় দিয়ে চালের গুড়ার পিঠা, যেটা সরিষার তেলে ভাজে। অর্থাৎ ভাজা পিঠা। ভাপা পিঠাও বেশ ভালো লাগে। পিঠা ছাড়া আমি থাকি না। পিঠা খাব না এটা কোন কথা হল। পিঁয়াজুও খাই। বেগুনিও খাই। শীতের সময় এগুলো খেতে তো আরও বেশি মজা লাগে।
আপনার বয়স তো ৮৬ বছর। শীতের এই পরিবর্তনটা কেমন দেখেন?
ছোটবেলায় আমি পালিয়ে বেড়াতাম। বাড়ির কাজের লোক দিয়ে মা আমাকে ধরে এনে গোসল করিয়ে দিতেন। দেখো, শীত যেমন আছে, তেমনি থাকবে। এটা মেনে নিতে হবে। মানসিকভাবে এটা প্রস্তুতি নিতে হবে। অকারণে হা-হুতাশ করে কোন লাভ হবে না। এই যে দেখছো, শীত যাতে না লাগে, ঠান্ডা যাতে না লাগে সে কারণে আমি মাফলার পড়েছি। শীত আসবে এটা মেনে নিয়েছি।