1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিশুদের অধিকার? তা খায় না মাথায় দেয়?

২৮ এপ্রিল ২০২৩

খাতায়-কলমে সব আছে৷ শিশুদের ভরাভর্তি অধিকার আছে৷ আইন আছে৷ আর বাস্তবে তারা বাঁচে অধিকারহীনতায়৷

https://p.dw.com/p/4Qev3
ভারতের তিন শিশু৷
ছবি: DW

সংবিধানের দেয়া অধিকার আছে, সংসদের করে দেয়া আইন আছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে, এক কথায় ভারতে বাচ্চারা আছে এবং বাচ্চাদের অধিকার ও অধিকাররক্ষার জন্য সব ব্যবস্থাই আছে৷ কিন্তু কাহিনি তো শুধু এটুকুই নয়৷ তাহলে তো এই লেখার কোনো দরকারই হত না৷ সম্পাদককে বলে দেয়া যেত, ভারত হলো বাচ্চাদের কাছে সব পেয়েছির দেশ৷ তা তো বলা যাচ্ছেই না, উল্টে বলতে হচ্ছে, যে ছবিটা উঠে আসছে, তা বড় অস্বস্তির, অশান্তির৷

ভারতে ৬ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত বিনা পয়সায় শিক্ষা বাধ্যতামূলক৷ দেশের সংবিধান ও আইন সেটাই বলছে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি কী বলছে? ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ২০১৯ থেকে ২১ বলছে, এখনো ২৮ শতাংশের বেশি বাচ্চা কোনো স্কুলেই যায় না৷ ১৪২ কোটির দেশে ১৫ বছরের কম বয়সিদের সংখ্যা প্রায় ৩৭ কোটি৷ তার মধ্যে নয় কোটির বেশি বাচ্চা কোনোদিন স্কুলেই গেল না৷ ১০ বছর বা তার বেশি সময় স্কুলে পড়েছে এমন মেয়ের সংখ্যা মাত্র ৪১ শতাংশ, ছেলের সংখ্যা ৫০ শতাংশ৷ অর্থাৎ, প্রায় ৬০ শতাংশ মেয়ে এবং পঞ্চাশ শতাংশ ছেলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরলো না৷

এই যে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে আসতে মিড ডে মিল চালু হলো, পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যে মেয়েরা স্কুলে গেলেই সাইকেল দেয়া হলো, কেউ ল্যাপটপ দিল, টাকা দিল, তার কী হলো? তারপরেও তো এত বাচ্চা স্কুলের বাইরে৷ শিক্ষার অধিকার নিয়ে কত লক্ষ পাতা লেখালেখি করা হয়েছে তার ঠিক নেই,, তারপরেও তো সেই শিক্ষার অধিকার অনেকের কাছে সেই পাতাতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল৷ দেশের সব গরিব পরিবার এখন বিনা পয়সায় সরকারের কাছ থেকে রেশন পায়, বাড়ি পায়, বয়স্ক ভাতা পায়, স্বাস্থ্যবিমা পায়, পশ্চিমবঙ্গে মেয়েরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে মাসে পাঁচশ টাকা পায়, বছরে একশ দিন কাজের গ্য়ারান্টি পায়৷ তার মানে তাদের না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না৷ বাচ্চাদের কাজ করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ ফলে বাচ্চাদের স্কুলে না যাওয়ার ক্ষেত্রে খুব জোরালো কোনো কারণ নেই৷ তারপরেও বাচ্চাদের শিক্ষার অধিকারের ছবিটা বড়ই করুণ৷

এখানেই শেষ নয়৷ ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের নিচে থাকা বাচ্চাদের ৬৭ শতাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে৷ হবে নাই বা কেন৷ ছয় থেকে ২৩ মাস বয়সি বাচ্চাদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশই তো উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য পাচ্ছে৷  ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে৷ ফলে বাচ্চা থেকে তাদের মায়েরা সকলেই অপুষ্টিতে ভুগছে৷ তাহলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কোথায় গেল? বিনা পয়সায় চাল, ডাল, গম ইত্যাদি পাওয়ার পরেও পুষ্টি হচ্ছে না৷ তার মানে হয় তারা বাড়তি পয়সা খাবারের জন্য খরচ করতে পারছে না অথবা সরকারি পরিকল্পনায় খামতি থেকে গেছে৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি এই সব প্রকল্পকে সফল করতে দিচ্ছে না৷ সমীক্ষা বলছে, গর্ভবতী হওয়ার পর প্রথম ১৮০ দিন আয়রন ট্য়াবলেট খাননি ৫৬ শতাংশ গর্ভবতী৷ অথচ এই ট্যাবলেট সরকার বিনা পয়সায় দেয়৷

এখনো জন্মের পরই  প্রতি হাজারটি বাচ্চার মধ্য়ে ২৪ জন মারা যায়, এক বছর বয়সের মধ্যে মারা যায় প্রতি হাজারে ৩৫টি বাচ্চা এবং পাঁচ বছর বয়সের মধ্য়ে প্রতি হাজারে প্রায় ৪২টি বাচ্চা মারা যায়৷ এত বাচ্চা তো তাহলে বেঁচে থাকার অধিকারই পেল না৷

যারা বড় হলো, অপুষ্টি নিয়ে বা অপুষ্টি ছাড়া, তাদের ১৫ থেকে ১৮-র মধ্যে বিয়ে দেয়া হলো৷ ২৩ শতাংশ মেয়েকেই ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ এরপর অধিকার নিয়ে কথা বলার আর কী দরকার আছে? মেয়েদের কোন কথাটা শোনা হয়?বাচ্চাদের তো বাড়িতে মতপ্রকাশের অধিকার পর্যন্ত নেই৷ বড়রা যা বলবে, সেভাবেই চলতে হবে, এটাই তো ইউক্লিডের উপপাদ্যের মতো সত্য৷ কথা কথায় তাদের মারধর করা হয়৷

কয়েক বছর আগে একবার উত্তরাখণ্ডের খিরসুতে গিয়েছিলাম বেড়াতে৷ সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি৷ দেখি, আমার মেয়েকে দেখে ওখানকার মেয়েরা খুব অবাকভাবে নিজেদের মধ্যে কিছু বলছে৷ তারপর তারা আমায় জিজ্ঞাসা করেই বসল, মেয়ের বয়স কত? বললাম, ১৫ বছর৷ রীতিমতো অবাক হয়ে পরের প্রশ্ন, এখনো বিয়ে হয়নি৷ এবার আমি অবাক হয়ে বললাম, বিয়ে হবে মানে৷ এখন পড়া শেষ করবে, চাকরি করবে, তারপর তো বিয়ে৷ এই কথা শুনে তাদের অবাক হওয়ার শক্তিও প্রায় চলে গেল৷ কোনোমতে বললো, আমাদের এখানে ১৫ বছরের নিচেই সব মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

সংবিধান আছে, আইন আছে, পুলিশ আছে, আদালত আছে, তবু অধিকার আছে কি? জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, ভারতে বাচ্চাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রবলভাবে রয়েছে৷ সব সামাজিক, আর্থিক গোষ্ঠীার বাচ্চারাই সহিংসতার শিকার৷ বাড়িতে সহিংসতা, স্কুলে সহিংসতা, পাড়ায় সহিংসতা৷ এর মধ্য়ে যৌন সহিংসতাও আছে, বাচ্চাদের পাচার করে দেয়া আছে, তাদের শ্রমিক হিসাবে কাজ করা আছে৷ 

জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো বলছে, ২০২০ সালে প্রতিদিন ৩৫০ জন বাচ্চার উপর সহিংসতা হয়েছে৷

সবমিলিয়ে বাচ্চাদের বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার অপরাধ হয়েছে৷ অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷  এই ব্যুরোর হিসাব বলছে, ভারতে প্রতিবছর ৪০ হাজার বাচ্চাকে অপহরণ করা হয়৷ ১১ হাজারের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না৷ আর প্রায় হাজার পঞ্চাশেক নারী ও শিশুকে পাচার করে দেয়া হয়৷

তাই শিশুদের অধিকার খাতায় কলমে থাক, তা নিয়ে নেতা-মন্ত্রীরা বড় বড় বক্তৃতা দিন৷ আমাদের পৃথিবী তো ছোট হতে হতে বোকা বাক্সে বন্দি৷ তার মধ্য়ে সংকীর্ণতা আছে, কুসংস্কার আছে, বোকা বোকা ধারণা আছে, বিচিত্র সব চিন্তাভাবনা আছে, সত্যকে চেপে দেয়া আছে৷ সেই দুনিয়ায় শিশুদের অধিকারের বড়ই অভাব৷