শিল্পের আয়ে শিল্পীর ভাগ নেই
৬ ডিসেম্বর ২০১৯সৌদি প্রবাসী বাসারের প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর৷ তাঁর এমন কোনো গান নেই যা তিনি শোনেননি৷ ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে থাকা অবস্থায় হাতের কাছে এই শিল্পীর যত অ্যালবাম পেয়েছেন, প্রায় সবক'টি কিনেছেন৷ এখন আর তাকে অ্যালবাম কিনতে হয় না, কিন্তু এন্ড্রু কিশোরের গান শোনাও দুরূহ না৷ বাসার বলেন, ‘‘যখন সৌদি আরবে আসি তখন ইউটিউবের এত প্রচলন ছিল না, কিন্ত বিভিন্ন সাইটে ঠিকই গান পাওয়া যেতো৷ আগে ক্যাসেট, সিডি কিনতে যে টাকা খরচ করতে হতো, এখন তা-ও লাগে না৷’’
বাংলাদেশে খুব কম স্রোতারই দেখা মিলবে যিনি গত এক দশকে অনলাইনে বা অন্য কোনো মাধ্যম থেকে গান শুনতে টাকা খরচ করেছেন৷ সংগীতের যে একটি বাজার ছিল সেটি হারিয়েই গেছে বলা চলে৷ আবার যেসব মাধ্যমে এখন শিল্পীদের গান চলছে, সেখান থেকেও তারা আয় বঞ্চিত হচ্ছেন৷
বাসারের প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কথাই ধরা যাক৷ তিনি এখন দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়ছেন সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে৷ দেশের সংগীতাঙ্গনের জনপ্রিয় এই শিল্পীকেও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ সেজন্য সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছেন তার শুভাকাঙ্খীরা৷ তার জন্য দেশে-বিদেশে কনসার্ট আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছেন সহশিল্পীরা৷শুধু এন্ড্রু কিশোর নন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের প্রথিতযশা অনেক শিল্পীকেই একটা সময় পড়তে হয়েছে আর্থিক সংকটে৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে সংগীত শিল্পী লাকী আখন্দ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা যান৷ এই শিল্পীও চিকিৎসা করাতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছেন৷ ১৯৭১ সালে গান গেয়ে যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন, উপহার দিয়েছেন কালজয়ী সব দেশাত্মবোধক গান, কিংবদন্তি সেই শিল্পী আব্দুল জব্বারের চিকিৎসাসেবাই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল টাকার অভাবে৷ পরে তার জন্য একটি চিকিৎসা সহায়তা কমিটি গঠন করেন শুভাকাঙ্খীরা৷ চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়া শিল্পীদের তালিকায় আরো আছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া, বিপুল ভট্টাচার্য, তিমির নন্দী, সংগীত পরিচালক ও সুরকার আলাউদ্দিন আলীসহ অনেকে৷ অথচ তাদের গাওয়া বা সৃষ্টিকরা গান এখনো জনপ্রিয়৷
শিল্পী নকিব খান আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘প্রত্যেকটা শিল্পী শেষ বয়সে এসে এই কষ্টটা পায় এবং চিকিৎসার জন্য যখন অর্থ দরকার হয়, তখন দুঃস্থ শিল্পী হয়ে যায়, সব শিল্পী মিলে সাহায্য করতে হয়৷ এটা খুবই দুঃখজনক৷’’
অ্যালবামের রয়্যালটি-বঞ্চনা
বাংলাদেশে গানের অ্যালবাম বের হওয়া শুরু হয় সত্তরের শেষ বা আশির দশকের শুরুতে, স্মৃতি হাতড়ে জানালেন নকিব খান৷ তিনি বলেন, ‘‘আয়ের ক্ষেত্রে অ্যালবাম তখন ভূমিকা রাখতো না, এখনো রাখে না৷ নরম্যালি কনসার্ট বা অন্য মাধ্যম থেকেই শিল্পীরা আয় করে থাকে৷’’
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, তখনকার স্টুডিও কোম্পানিগুলো গানের স্বত্ব বা রয়্যালটি দিতো না৷ তার বদলে এককালীন কিছু টাকা পেতেন শিল্পীরা৷ সেই অ্যালবাম বা গান যতই আয় করুক সেখান থেকে আর কোনো ভাগ পান না তারা৷
শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তিনিও কখনো কোনো অ্যালবামের রয়্যালটি পাননি৷ ‘‘সঙ্গীতা বলেন, সাউন্ডটেক বলেন, এদের অ্যালবাম বিক্রির উপর কোনো ভাগ আমরা কোনোদিনও পাইনি৷ এককালীন একটা লামসাম দিয়ে দিতো৷’’
সমস্যা হলো, এই ‘লামসাম' টাকা আয়েরও এখন পথ নেই শিল্পীদের৷ কেননা, অ্যালবাম বের হওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে, বিনিয়োগ করছে না কোনো মিউজিক কোম্পানি৷ ‘‘একটা অ্যালবাম বের করতে হয়তো ৫ লাখ টাকা খরচ হয়৷ সেখানে ১ লাখ টাকাও উঠে না৷ পাইরেসির কারণে ইন্ডাস্ট্রিটা ধ্বংস হয়ে গেছে,’’ বলেন নকিব খান৷
ডিজিটাল মাধ্যমে কারা আয় করে?
অ্যালবাম প্রকাশ না হলেও এই শিল্পীদের গান যে কেউ শুনছেন না এমনটাও কিন্তু নয়৷ এমন কোনো গান বা অ্যালবাম নেই যেটি এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে না৷ শুধু ইউটিউবে সাবিনা ইয়াসমিনের নামে র্সাচ দিলেই কয়েক হাজার গানের সন্ধান মিলে৷ তার আঠারোটি গান নিয়ে তৈরি একটি ভিডিওই দেখা হয়েছে ৬৩ লাখ বারের বেশি৷ এই শিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘ইউটিউবে আমার হাজার হাজার গান আছে, কোনেকিছুই জানি না কারা আপলোড করছে৷’’
লোকজ শিল্পীরা পড়েছেন আরো বিপাকে৷ তাদের অনেকেই ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত নন৷ বিভিন্নজন নামমাত্র টাকা দিয়ে তাদের গান রেকর্ড করেন৷ এই বিষয়ে ডয়চে ভেলের কাছে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন কুদ্দুস বয়াতি৷ ‘‘মোবাইল, ইউটিউবের জন্য এক একজন আসে৷ (গান রেকর্ড) করে দুই তিন হাজার টাকা দেয়৷ ক্যামেরা করে তারা রেখে দেয়, তারপর ইউটিইবে চালায়,’’ বলেন কুদ্দুস বয়াতি৷
শিল্পী আসিফ আকবর মনে করেন, ডিজিটাল মাধ্যম বুঝে উঠতে না পারায় শিল্পীরা এখন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্চেন৷ ‘‘সবাই ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড বলতে বোঝে ইউটিউবকে, যেটা মাত্র সেভেন পার্সেন্ট৷ বাকি যে ৯৩ পার্সেন্ট আছে আমরা সেটা ধরতে পারছি না৷’’
তার মতে, এই অজ্ঞতার কারণেই তৃতীয় পক্ষ এখান থেকে লাভবান হচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেল, এফএম রেডিও, কনটেন্ট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান আর মোবাইল অপারেটররা শিল্পীদের গান থেকে আয়ের সুযোগ পাচ্ছে, কিন্তু বঞ্চিত হচ্ছেন শিল্পীরা৷
মোবাইলে কোটি কোটি টাকার লেনদেন
দেশে এখন ১৬ কোটি মোবাইল সংযোগ আছে৷ তাদের অনেকেই প্রতিমাসে নির্দিষ্ট ফি-এর বিনিময়ে ওয়েলকাম টিউন, রিংটোনে গান ব্যবহার করছেন, যার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে৷ কিন্তু এই টাকা থেকে গানের শিল্পী, সুরকার কিংবা গীতিকাররা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ সাবিনা ইয়াসমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিল্পীদের কোটি কোটি টাকা সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে৷ কারা খাচ্ছে আমি জানি না৷ মোবাইল অপারেটররা, যারা এখান থেকে ইনকাম করছে. এটাতে শিল্পীদের কোনো কিছু নেই৷’’
মোবাইল অপারেটরদের দাবি মিউজিক কনটেন্টের আয় শেয়ার হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসির ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বা ভ্যাস গাইডলাইন অনুসারে৷ সেখানে আয়ের ৪০ ভাগ পায় কনটেন্ট প্রোভাইডার আর ৬০ ভাগ পায় মোবাইল অপারেটররা৷ রবির কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান শাহেদ আলম জানান, কনটেন্ট প্রোভাইডাররাই শিল্পীদের সঙ্গে চুক্তি করেন৷ মোবাইল অপারেটররা সেই চুক্তিনামা দেখেই তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের অনুমোদন দেন৷ আয়ের অংশ কোনো আর্টিস্ট পাচ্ছে কিনা সেটি তাদের চেক করার উপায় থাকে না৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে কোনো কপিরাইট সোসাইটি নেই৷ আমরা সরকারকে বারবার বলে আসছি, শিল্পীদেরও বলেছি আপনারা কপিরাইট সোসাইটি গড়ে তুলুন, তাহলে রাইটটা প্রয়োগ করতে পারবেন৷ আমরাও এক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা দেবো৷’’
শিল্পীরা কি সাহায্য নির্ভরই থাকবেন?
‘দুঃস্থ শিল্পীদের' আর্থিক সহায়তা দেন প্রধানমন্ত্রী৷ কিন্তু বিষয়টিকে শিল্পীদের জন্য অসম্মানজনক বলেই মনে করেন আসিফ আকবর৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো কিছু হলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের টাকা নিয়ে টানাটানি, এটা একটা ব্যাধির আকারে পরিণত হয়েছে৷ এটা নিয়ে মানুষজনও হাসাহাসি করে৷ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেন শিল্পীদের চিকিৎসা করা হবে? এটার পক্ষে আমি মোটেও না৷’’
তার মতে, যারা তারকা তারাই এই সুবিধাটা পাচ্ছেন৷ ‘‘যারা মিউজিশিয়ান আছেন, যারা তবলা ভায়োলিন বাজান, সেতার-সন্তুর বাজান, তারা কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য পায় না, কারণ তাদের কান্নাটা সরকারের কাছে পৌছাচ্ছে না৷ মিডিয়াতে যাচ্ছে না৷ সেক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েই গেল৷ তারকা হলে আপনি সরকারের সহায়তা পেতে পারেন, না চিনলে টাকা দেয়া হবে না৷’’
শিল্পীদের এমন অবস্থায় কেন পড়তে হবে তা নিয়েই ক্ষোভ সাবিনা ইয়াসমিনের৷ তিনি বলেন, ‘‘রয়্যালটির টাকা মেরেকেটে না খেলে কি আমাদের কারো কাছে হাত পাততে হয়? এন্ড্রু কিশোর, আলাউদ্দিন আলীর মতো মানুষদের লক্ষ লক্ষ গান পপুলার, তাদেরকে কেন মানুষের কাছে চাইতে হবে? এক হাজার গানের রয়্যালটি পেলেও তাদের অনেক সাহায্য হবে৷’’
শিল্পীদের করণীয় কী?
কপিরাইট আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, ‘‘একজন শিল্পী যখন তার গান রেকর্ড করে বাজারে ছাড়েন, সেটি তার কপিরাইট কর্ম৷ ওই গানের জন্য গীতিকার, সুরকার বা শিল্পী সবারই কপিরাইট আছে৷ কিন্তু শিল্পীরা এই বিষয়ে সচেতন নন৷ তারা কখনোই সংগঠিত হয়ে সম্মিলিতভাবে কোনে পদক্ষেপ নেননি৷’’
এই পরিস্থিতির জন্য শিল্পীদের মধ্যে ঐক্য না থাকাকেই দায়ী করেন আসিফ৷ ‘‘৪৮ বছরেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি’’, আক্ষেপ করে বলেন বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসা সফল অ্যালবামের শিল্পী৷ তবে হতাশ নন নকিব খান৷ তার মতে, আন্তর্জাতিক প্রোপার্টি রাইটস আইন শক্তিশালী হচ্ছে৷ মিউজিশিয়ানরাও সজাগ ও সচেতন হচ্ছেন৷ তাই সামনে সুদিন আসতে পারে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷