শিল্পস্থাপনা ভাঙচুর: আরেক ভয়ের সংস্কৃতি
১০ আগস্ট ২০২৪৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।এই খবর আসার কিছু সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেশ কিছু ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। সেখানে চলে লুটপাট। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিধন্য এই বাড়ি ভস্মীভূত হওয়ার বিষয়টি মানতে পারেননি চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক দফার সমর্থক হয়েও তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, "আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর একটা জরুরি কাজ হবে ৩২ নম্বরের বাড়ির সংস্কার কাজ শুরু করা।”
এই ভবন আগের চেহারায় আনা গেলেও ছাই হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত অনেক উপকরণই আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। একই পরিণতির শিকার কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের দুর্লভ ও শতবর্ষী হাজারো বই। সরকার পতনের বিজয় মিছিলে অংশ নেয়া একদল লোক দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই পাঠাগারে আগুন দেয়। লুটপাটও
চালায় তারা।
লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের শিকার রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কেরই জলের গানের গায়ক রাহুল আনন্দের বাড়ি। ছাত্র আন্দোলনে সামিল হওয়া এই বাদ্যযন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, "প্রায় তিন হাজার বাদ্যযন্ত্র পুড়ে ছাই। ওরা আমার সন্তানের মতো। আমি একটা মানুষ বাচ্চাকে জীবিত নিয়ে বের হতে পেরেছি। বাকিরা পুড়েছে বা লুট হয়েছে।”
রাহুল আনন্দের এই ক্ষতির প্রতিবাদে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভাস্কর্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় ভাঙচুরের প্রতিবাদে ৯ আগস্ট শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে উদীচী।
মাঠে নেমেছে ‘বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। ৭ আগস্ট বুধবার ঢাকার জাতীয় নাট্যশালার সামনে তাদের অবস্থান কর্মসূচিতে জানানো হয়, এখন অবধি সাতটি থিয়েটার দলে আগুন দেওয়া হয়েছে। শিল্প, শিল্প স্থাপনা, ঐতিহাসিক স্থাপনার সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্ন তুলেন তারা। সেখানে লিখিত বক্তব্য দেন নাট্যসংগঠন বটতলার পরিচালক কাজী রোকসানা রুমা।
এই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটি সরকারের পতনের পর আমরা যখন বৈষম্যহীন একটা সমাজ ও গণতান্ত্রিক একটা দেশ দেখতে চাই, তখন বিভিন্ন শিল্পস্থাপনা ভাঙা হচ্ছে, এটা ভীষণ অন্যায়। পতন হওয়া স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি এভাবে রাগ প্রকাশ করাটা আসলে মননে শিক্ষার অভাব।''
অভিনয়শিল্পী কাজী রোকসানা রুমা আরো যোগ করেন, "আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশটা ঠিকঠাক মতো হয়নি। শিল্প বিকাশের চেয়ে আগের সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের দিকেই বেশি নজর রেখেছে, তাদের বেশি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এর বাইরে যারা আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির কর্ণধার তারা যে সংস্কৃতির চর্চা ছড়িয়ে দিতে কাজ করেছেন, সেটাও আমাদের চোখে পড়েনি। তাই আমরা জনমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি।”
হামলার মুখে শিল্পকলা, সিনেমা হল
সরকার পতনের পর দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরের সড়ক চত্বরে থাকা অনেক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। হামলা করা হচ্ছে সিনেমা হলেও। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, নাটোরের গুরুদাসপুরে আনন্দ সিনেপ্লেক্সে ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা। ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার গুরুদাসপুরের চাঁচকৈড়ের গিয়াসের মোড় এলাকায় থাকা এ প্রেক্ষাগৃহ থেকে অন্তত ৩০ লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়।
সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন জেলা শিল্পকলা ও শিশু একাডেমিও আক্রান্ত হচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমিগুলোর কালচারাল অফিসারদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবেদনও তৈরি করছে। যেখানে বলা হয়েছে, জেলা-উপজেলার ২২টির বেশি শিল্পকলা একাডেমিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। দুর্বৃত্তরা হারমোনিয়াম, তানপুরাসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, কম্পিউটার, প্রজেক্টর, ক্যামেরাসহ মিলনায়তনের জিনিসপত্র ভাঙচুর ও লুট করেছে।
এসব হামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে, নাকি প্রগতিশীল শিল্পচর্চার বিরুদ্ধে- জানতে চাইলে লেখক ও প্রকাশক রবীন আহসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার পতনের পর একটি অংশ ভাস্কর্য ভেঙে বুঝাতে চাইছে দেশে ইসলামি বিপ্লব হয়েছে। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, বাচ্চাদের গানের স্কুল- এসব জায়গায় হামলা রাজনৈতিক ক্ষোভ থেকে নয়, হামলাকারীরা বরং বলতে চায়, এসব চর্চা আর করা যাবে না।”
নতুন সরকার শিল্প-অঙ্গনের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কী করতে পারে? এমন প্রশ্নে সংস্কৃতিকর্মী রবীন আহসান বলেন, "ঐতিহ্যবাহী একটি ভাস্কর্য তো আর নতুন করে বানানো সম্ভব নয়। নতুন সরকারের পক্ষে কম সময়ের মধ্যে এগুলো করা সম্ভবও নয়।”
তিনি আরো যোগ করেন, "মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙা হচ্ছে, আর তরুণেরা মোবাইলে ভিডিও করছে, হাসছে- এটা কিন্তু বিকট একটা চেহারা। এর ফলে মানুষের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করার যে ভয়টা ঢুকে গেছে, সেটা কাটাতে প্রচুর সময় লাগবে।”