শিক্ষামন্ত্রী দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেন!
২৪ জানুয়ারি ২০১৮প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঘুস, দুর্নীতি, পাঠ্যপুস্তক বিতর্ক– এমন নানা বিষয় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনায়৷ বাংলাদেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়৷ এবার পঞ্চম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাও ঘটেছে৷ মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস তো নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এর জন্য কখনো শিক্ষকদের, কখানো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দায়ী করেন৷ কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস তিনি ঠোকাতে পারেননি৷ তাই তিনি মঙ্গলবার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে পরীক্ষার সময় ফেসবুক বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন৷ কিন্তু তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এরইমধ্যে এর বিরোধিতা করেছেন৷ ই কমার্সের সঙ্গে জড়িতরা এটাকে বলেছেন ‘তুঘলকি কাণ্ড'৷
পাঠ্যপুস্তকের ‘হেফাজতিকরন' হয়েছে ২০১৬ সালে৷ হেফাজতের সুপারিশে অনেক লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে৷ কথা ছিল, এবার তা ঠিক করা হবে৷ কিন্তু যাঁদের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে, তাঁদের লেখা আর ফেরত আনা হয়নি৷ ছাগল এবং ওড়না বিতর্কের অবসানের চেষ্টা করা হয়েছে ভিন্নভাবে৷ ‘ওড়না' প্রাথমিক থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে প্রাক প্রাথমিকে৷ আর ছাগলকে গাছ থেকে নামানো হয়েছে ঠিকই, তবে ছাগলের ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে৷ আর ছাগল না লিখে ‘অজ'-এর মতো অপ্রচলিত শব্দ রাখা হয়েছে৷
তবে এসব বিষয়ের বাইরে গত মাসে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষাখাতে ‘সহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি' করার কথা বলে ব্যাপক আলোচনায় আসেন৷ তিনি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রনালয়, বিশেষ করে শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বলেন, ‘‘ঘুস খান, তবে সহনীয় মাত্রায় খান৷'' শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য পরে এর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু সে ব্যাখ্যা গ্রহনযোগ্য হয়নি বিশ্লেষকদের কাছে৷ টিআইবি এই ইস্যুতে তাঁর পদত্যাগও দাবি করে৷
‘সহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি'র ইস্যু নিয়ে আলোচনা চলার সময়ই গত সোমবার শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন ও মন্ত্রনালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসিরুদ্দিন ঘুস নেয়ার অভিযোগে আটক হন৷ তারা জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে বন্ধ হওয়া লেকহেড গ্রামার স্কুল খুলে দিতে এমডি আব্দুল মতিনের কাছ থেকে মোট সাড়ে চার লাখ টাকা ঘুস নেয়ার চুক্তি করেন৷ কয়েক দফায় তারা টাকাও নেন৷ শেষ দফায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকা নিতে গিয়ে ঘুসের টাকাসহ আটক হন৷ মতিনকেও আটক করে পুলিশ৷ পুলিশের দায়ের করা এজাহারে বলা হয়েছে, আটক ওই দুই কর্মকর্তা ছাড়াও আরো কয়েকজন কর্মকর্তা এই ঘুস নেয়ার সঙ্গে জড়িত৷ এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে ওই দুই কর্মকর্তার বিলাসবহুল বাড়ি, ফ্ল্যাট ও গাড়ির ছবি ও খবর ছাপা হয়েছে৷ কিন্তু তাদের কারোই বেতন ২৮ হাজার টাকার বেশি নয়৷ মোতালেব গত দুই বছর ধরে শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মাকর্তা হিসেবে কাজ করে আসছিলেন৷ তাদের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসেরও অভিযোগ করা হয়েছে৷
২০১২ সালে এই শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরের এমএলএসএস (পিয়ন) মো. আলীকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল৷ পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যায়৷ এখনো তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরেই কর্মরত৷
তারা আটক হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, তারা যে দুর্নীতি করেন, সেই খবর তার কাছে ছিল না৷ পরে অববশ্য দু'জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়৷
২০১৫ সালে টিআইবি'র সেবাখাতে ঘুস সংক্রান্ত জরিপে বলা হয়, শিক্ষা খাতে সেবা নিতে যাওয়া সাধারণ মানুষের শতকরা ৬০ ভাগকে ঘুস দিতে হয়েছে৷ জরিপে অংশ নেয়াদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সেবা নিতে তারা শিক্ষা খাতে মোট ৪১৩ কোটি টাকা ঘুস দিয়েছেন। শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা ভবনের ইট, পাথরও নাকি ঘুস খায়– এমন কথা প্রচলিত আছে৷ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ), শিক্ষা বোর্ড-এর কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধেও আছে ব্যাপক ঘুসের অভিযোগ৷''
টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশের সব সেবাখাতের মতো শিক্ষাখাতও দুর্নীতিগ্রস্ত৷ আমাদের বিভিন্ন জরিপে তা উঠে এসেছে৷ কিন্তু শিক্ষাখাতে এই দুর্নীতি জাতির জন্য অনেক খারাপ খবর৷ এখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি বড় সংকটে পরিণত হয়েছে৷ এখানে সেবা নিতে ঘুস দিতে হয়৷ শিক্ষামন্ত্রী যখন এই খাতে সহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি করার কথা বলেন, তখন তিনি দুর্নীতিকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে আরো উৎসাহিত করেন৷ তাই আমরা নৈতিক জায়গা থেকে তাঁকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘এই দুর্নীতি এককভাবে হয় না৷ এর সঙ্গে মন্ত্রনালয়ের অভ্যন্তরেই সিন্ডিকেট আছে৷ তারা সবাই ভাগ পায়৷ সেই ভাগ কোন পর্যন্ত যায় তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷ শিক্ষামন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি করেন তা আমি বিশ্বাস করি না৷ তবে তিনি সহনীয় দুর্নীতির কথা বলে,তার চারপাশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে প্রকারান্তরে দুর্নীতিকে সুরক্ষা দিচ্ছেন৷ দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেয়াও দুর্নীতি৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কি অল্পদিন হয় যোগ দিয়েছেন? তিনি কি এই প্রথম ঘুস নিলেন? তা যদি না হয় তাহলে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতি শিক্ষামন্ত্রীর চোখে পড়বেনা কেন? তিনি তো চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন৷ সবাই তাদের অবৈধ সম্পদের কথা জানেন, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী জানবেন না, এটা কী করে হয়!''
এই দুর্নীতির ফলাফল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিউটের অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান ডয়চে ভেলেবে বলেন, ‘‘শিক্ষাখাতে দুর্নীতির নানামুখী নেতিবাচক প্রভাব আছে৷ এর ফলে মানব সম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়৷ দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষার্থী, তাদেরও নৈতিক অবক্ষয় ঘটতে পারে৷ পরবর্তী জীবনে তারাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে৷ আর শিক্ষার মান কমে যায়৷ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থ দুর্নীতিবাজদের পেটে যায়৷ অযোগ্য লোক নিয়োগ পায়৷ সব মিলিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়ে৷''
শুধু এখানেই শেষ নয়৷ শিক্ষামন্ত্রী কোচিং ব্যবসা এবং নোট বইয়ের নামে গাইড বই'র ব্যবসা বন্ধেও ব্যর্থ হয়েছেন৷
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে আপনার মন্তব্য লিখুন নিচের ঘরে৷