আবার শার্লি এব্দো
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫শার্লি এব্দো চিরকালই বিতর্ক ঘেঁষা৷ প্রতিষ্ঠা যাবৎ পত্রিকাটি বারংবার বাকস্বাধীনতার সীমা পরখ করে নিয়েছে৷ ব্যঙ্গ এবং ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যের কোনো সীমানা থাকতে পারে না, এই বিশ্বাস নিয়ে শার্লি এব্দো বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর যাবতীয় ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার পরোয়া না করে কার্টুন প্রকাশ করেছে৷ পশ্চিমি বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলিতে স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গাত্মক রচনা যে শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, শুধু তাই নয়, সেই স্যাটায়ারের ভিত্তিই হলো এই নীতি৷ স্যাটায়ার বা কার্টুন যেভাবে স্বল্পপরিসরে বিধ্বংসী প্রভাব নিয়ে যে কোনো মতামতকে পরিবেশন করতে পারে অথবা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, সেটা কোনো সম্পাদকীয়তে করা সম্ভব নয়৷
হজরত মুহাম্মদের কার্টুন ছাপার কারণে উগ্র ইসলামপন্থিরা শার্লি এব্দোর উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ চালায় গত জানুয়ারি মাসে৷ শার্লি এব্দো ব্যঙ্গচিত্রগুলি ছাপিয়েছিল এটা প্রমাণ করার জন্য যে, স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গরচনা কোনো বাধানিষেধ মানে না; যার সমালোচনা করা উচিত, তার সমালোচনা করার অধিকার আছে স্যাটায়ারিস্ট বা কার্টুনিস্টের, এই হলো শার্লি এব্দোর নীতি৷ পশ্চিমে ফ্রি মিডিয়া বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সব দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও, এখানকার মানুষ কোন পত্রপত্রিকা কিনবেন অথবা পড়বেন বা পড়বেন না, তা তাঁরা নিজেরাই ঠিক করেন৷
শার্লি এব্দো আবার বিতর্কের মুখে পড়েছে তার শেষ পাতায় ইউরোপে শরণার্থী সংকট সংক্রান্ত কিছু কার্টুন প্রকাশ করে – বিশেষ করে দু'টি ব্যঙ্গচিত্র৷ উভয়ের বিষয়ই হলো আয়লান কুর্দি, সেই তিন বছরের সিরীয় শিশু, যার মৃতদেহ সমুদ্রসৈকতে ভেসে উঠেছিল৷ আয়লানের সেই স্পন্দনহীন ছোট্ট দেহটির ছবি সারা বিশ্বকে সচকিত করে৷ বলতে কি, ঐ একটি ছবি যেন শরণার্থীদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-বিড়ম্বনার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়৷
শার্লি এব্দোর কার্টুনে আয়লানের মৃতদেহ যে সৈকতে, সেখানেই একটি ফাস্ট-ফুড-চেনের বিজ্ঞাপন: ‘‘পোমোশনাল অফার: কিডস মেনু, একটির দামে দু'টি''৷ ব্যঙ্গচিত্রের ক্যাপশন হলো: ‘‘অভিবাসীদের স্বাগত জানাচ্ছি, অভীপ্স লক্ষ্যের এত কাছে...৷''
শার্লি এব্দো দৃশ্যত পশ্চিমি জীবনযাত্রার ধরন এবং শরণার্থীদের বাসনা-কামনা, উভয়কেই ব্যঙ্গ করতে চেয়েছে৷ অপর কার্টুনটিতে যিশুখ্রিষ্ট জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, বাইবেলে যেমন আছে৷ কার্টুনের ক্যাপশন: ‘‘খ্রিষ্টানরা জলের ওপর দিয়ে হাঁটে; মুসলিম শিশুরা ডুবে মরে৷'' অর্থাৎ খ্রিষ্টান ইউরোপের নৈতিকতা এবং ভণ্ডামির দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে এই ব্যঙ্গচিত্রে৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকট নিয়ে সম্প্রতি যা ঘটছে, তা নিয়ে ব্যঙ্গ করা প্রয়োজনীয় এবং বৈধ তো বটেই৷ কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস যে, আয়লান কুর্দির ছবি ব্যবহার করাটা একটা বড় আকারের সম্পাদকীয় প্রমাদ৷ একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি, একটি শিশু ও তার মাত্র কয়েক বছরের বড় সহোদরের মৃত্যু – এক কথায় শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট-বিড়ম্বনা, এ ধরনের স্যাটায়ারের বিষয় হতে পারে না৷ এটা শুধু অশালীনই নয়, আমার কাছে তা ঘৃণার উপযুক্ত৷ অনেকে হয়ত এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন না, এবং স্বভাবতই আমি তাদের মনোভাবকে শ্রদ্ধা করে চলব৷ কিন্তু এ-ও সত্যি যে, আমি শার্লি এব্দোর এই সংস্করণটি কিনব না৷
এই ক'টি অশালীন কার্টুনের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো চলে না৷ তবুও আমি ফরাসি দার্শনিক, কবি ভলটেয়ার-এর একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না: ‘‘তুমি যা বলছো, তা আমার মনঃপূত না হতে পারে৷ কিন্তু আমি আমার জীবন দিয়ে তোমার এই বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করবো৷''