1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লোডশেডিংয়ে ধীর শিল্পের চাকা, স্থবির জনজীবন

৫ জুলাই ২০২২

হঠাৎ করেই বিদ্যুতের লোডশেডিং ভয়াবহভাবে বেড়ে গেছে৷ কেন বিদ্যুতের এত ঘাটতি দেখা দিলো? বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কেন চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না?

https://p.dw.com/p/4Dh0B
Bangladesh Blackout
ফাইল ফটোছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

সরকার থেকে জ্বালানি সংকট, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর অধিক নির্ভরতা, লোডশেডিংয়ে রেশনিংয়ে সমন্বয়হীনতার কারণে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি এম এ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ এর ফলে আমরা সঠিক সময়ে শিপমেন্ট করতে পারছি না৷ যার প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের টাকাও দেওয়া যাচ্ছে না সঠিক সময়ে৷ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনেও এর প্রভাব পড়ছে৷ সবকিছু মিলিয়ে শিল্প উদ্যোক্তারা খুবই কঠিন সময় পার করছেন৷”

বিদ্যুৎ সংকটের কারণে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ ও জ্বলানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু৷ সোমবার দেওয়া পোস্টে তিনি বলেছেন, "গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে৷ এতে অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে৷ গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে৷ যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে৷ এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি৷”

এম এ হাতেম

হঠাৎ করেই কেন এই সংকট? জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে৷ তাছাড়া দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ অনেক কম৷ এর বাইরে আরও কয়েকটি কারণ আছে৷ সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, সেই কাজ চলছে৷ ভারত থেকে ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত, ওদের ওই কেন্দ্রটির সমস্যা হয়েছে ফলে সেটাও আসছে না৷ তবে কয়েকটি কেন্দ্রের সংস্কার শেষ হয়েছে আজ (মঙ্গলবার) থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করছি৷”

বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে৷ আর আমাদের যতগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে তার সব মিলিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট৷ ফলে সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে একসঙ্গে উৎপাদনে যেতে হয় না৷ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত রোববার দেড় হাজার এবং সোমবার এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে৷ কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশজুড়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং যেভাবে শুরু হয়েছে, তাতে ঘাটতির পরিমাণ আড়াই হাজার মেগাওয়াটের কম হবে না৷

জ্বালানি সংকটের শিগগিরই কোন সমাধান হওয়ার পূর্বাভাস সরকারি তরফ থেকেও দিতে পারছে না৷ ফলে বিদ্যুতের আসা যাওয়া বা লোডশেডিংও শিগগিরই কমবে এমন কোন আশ্বাসও নেই৷ ঈদের ছুটিকালীন সময়ে শিল্প ও বাণিজ্যিকে চাহিদা কমলেও আবাসিকে চাহিদা বাড়বে৷ এর ফলে এখনকার সময়ের চেয়ে ঈদের সময়ে আবাসিকে লোডশেডিং কিছুটা কমবে৷ তবে উৎস জ্বালানির পর্যাপ্ত জোগান না থাকায় চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমাধান চলতি জুলাই মাসে হবে না৷ ফলে জুলাই মাসজুড়ে বিদ্যুতের কমবেশি আসা-যাওয়া থাকবে৷ সার্বিকভাবে লোডশেডিং যেন তীব্র হয়ে না উঠে সেজন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে রেশনিং করতে অর্থাৎ দিনের নির্ধারিত সময়ে ব্যবহার না করতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিগুলো৷ এর আগে গত রমজানে শিল্প-কারখানাগুলোতে  প্রতিদিন ৪ ঘন্টা গ্যাস সরবরাহ-ব্যবহার বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দিয়েছিল পেট্রোবাংলা৷

মাহবুবুর রহমান

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি প্রকৌশলী শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিশ্ব বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়েছে সত্যি৷ কিন্তু তারা যে ঘাটতির কথা বলছেন, তার সঙ্গে লোডশেডিংয়ের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না৷ গ্রামে তো এখন বিদ্যুৎ কখনও কখনও আসছে৷ শহরেও লোডশেডিং হচ্ছে কয়েক ঘন্টা৷ মাত্র দেড় হাজার মেগাওয়াট যদি ঘাটতি হয় তাহলে ৬০০ উপজেলার মধ্যে রেশনিং করা হলে প্রতি উপজেলায় মাত্র আড়াই মেগাওয়াট করে ঘাটতি হওয়া কথা৷ এতে একটি উপজেলায় মাত্র দুই থেকে তিন ঘন্টা লোডশেডিং হওয়ার কথা৷ কিন্তু হচ্ছে তো তার চেয়ে অনেক বেশি৷ আসলে সরকার বিতরণ ও রেশনিং ব্যবস্থা ঠিকভাবে করতে পারলে মানুষের এত দুর্ভোগ হওয়ার কথা না৷”

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে৷ স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে এ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে৷ ব্যয়বহুল এ জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে আরও বেড়েছে৷ বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৩৮ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে৷ সর্বশেষ কেনা হয়েছিল ২৫ ডলারে৷ ফলে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহারের সক্ষমতা থাকলেও তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ বর্তমানে খোলা বাজার থেকে এলএনজি কেনা স্থগিত রয়েছে৷ 

সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার যেটা বলছে সেটা সত্যি৷ কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও গ্যাসের দাম যেভাবে বেড়েছে সেটা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে৷ সেটা এখন সরকার চাচ্ছে না৷ ফলে সরকারের তরফ থেকে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে অনুরোধ করা হচ্ছে৷ এভাবেই কিছুদিন পরিস্থিতি সামলাতে চায় সরকার৷ এর কোন বিকল্পও সরকারের হাতে নেই৷”

গ্যাস সংকট ও বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে ভোগান্তি ও দুর্দশার কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ৷ বিশেষ করে যে সকল বাসায় অসুস্থ রোগী রয়েছে তারা বেশি বিপাকে পড়েছেন৷

মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ব্যাখা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তিনি বলেছেন, বিদ্যুৎ আমরা সবার ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সবাই পাচ্ছিল৷ কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে উপকরণগুলো সেগুলোর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়ে গেছে৷ যেমন ডিজেলের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে, এলএনজির দামসহ সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে৷ কয়লা এখন প্রায় পাওয়াই যায় না৷ তেল, গ্যাসসহ বিদ্যুৎ তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে গেছে৷ বিশ্বের অনেক দেশেই বিদ্যুতের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে৷ অনেক উন্নত দেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জানিয়ে এমন পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়মুখী হওয়ার আহবান জানান তিনি৷

এদিকে লোডশেডিংয়ের সমালোচনা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷ দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, "উন্নয়নের এতো যে ঢাকঢোল বাজানো হলো, তাহলে সারাদেশে লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতি কেন? বিদ্যুৎ নিয়ে নানা রঙচঙয়ের কথা বলা হয়েছে৷ জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই এখন অচল৷ ফলে লোডশেডিংয়ের ভয়াবহ ছোবলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ রাজধানীও বিপন্ন হয়ে পড়েছে৷”

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য