লিচুর কীটনাশকেই ১২ শিশুর মৃত্যু
২৫ জুলাই ২০১৭‘অ্যামেরিকান জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন' নামের জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে ‘এনডোসুলফান' নামের কীটনাশককে ঐ রাসায়নিকের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়৷ বার্তা সংস্থা এএফপি-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ঐ কীটনাশকটি ৮০টিরও বেশি দেশে নিষিদ্ধ৷ তবে বাংলাদেশের লিচুতে এখনো সেই কীটনাশক ব্যবহার করা হয় কিনা, তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
২০১২ সালের ৩১ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দিনাজপুরে ১৪ জন শিশু ‘অ্যাকিউট এনসেফালাইটিস সিনড্রোম'-এ (এইএস) আক্রান্ত হয়৷ তাদের বয়স ছিল ১ থেকে ১২ বছর৷ তারা সকলেই লিচু বাগানের আশেপাশে কিংবা ১০ মিটারের মধ্যে বাস করতো৷ আক্রান্তদের মধ্যে একটি শিশু প্রাণে বেঁচে গেলেও বাকিদের সবার মৃত্যু হয়৷ প্রসঙ্গত তখন বলা হয়েছিল, লিচুর বিষাক্ত বীজ খেয়ে ফেলার কারণে তাদের মৃত্যু ঘটে৷
২০১২ সালের ঐ ঘটনা নিয়ে গবেষণাকারী এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্চ'-এর সহকারী বিজ্ঞানী এম. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে লিচুর বীজ খাওয়ার কারণে ঐ শিশুদের মৃত্যু হয়নি৷ তাছাড়া বাংলাদেশে লিচুর বীজ খাওয়াও হয় না৷ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার কারণে ২০১২ সালে শিশুদের প্রাণ হারাতে হয়৷ যদি বিষাক্ত বীজের কারণে প্রাণহানি হতো, তাহলে তা ছোট একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তো৷''
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম কোর্ট হাউস নিউজ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘লিচু বাগানগুলোতে যে বিভিন্ন রকমের এবং প্রচুর কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে গবেষকরা খালি কীটনাশকের কৌটাসহ বাস্তব প্রমাণ পেয়েছেন৷ তাছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারাও সাক্ষ্য দিয়েছেন৷'
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘স্থানীয় লোকজন আমাদের বলেছেন, মাঝে মাঝে এত বেশি স্প্রে করা হতো যে, তাঁদের পক্ষে বাড়িতে থাকাটাই কষ্টের হয়ে যেত৷ শুধু তাই নয়, বেশ কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত থেকে যেত কীটনাশকের গন্ধ৷''
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়া ডিজিজ রিসার্স-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ. এস. এম. আলমগীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঘটনার পর আমরা তখন প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করেছিলাম৷ এটা নিয়ে পরে নানা ধরনের গবেষণাও হয়েছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমাদের এখানেও গবেষণা হয়েছে৷ সেই সব গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বিষাক্ত কেমিক্যালের কারণেই ঐ শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল৷ আর সেই রাসায়নিক এক ধরনের কীটনাশক থেকেই এসেছে৷''
দিনাজপুরের লিচু চাষী মোহাম্মদ সেলিম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘লিচুর ফুল থেকে ফল আসা পর্যন্ত কমপক্ষে চারবার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়৷ আমরা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেই কোন কীটনাশক ব্যবহার করবো, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই৷''
‘এনডোসালফান' নামের কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা অনেক ধরনের এবং নামের কীটনাশক ব্যবহার করি৷ তবে ঐ নামের কোনো কীটনাশকের নাম আমার মনে পড়ছে না৷ কেউ ব্যবহার করছে কিনা, তাও আমার জানা নাই৷''
দিনাজপুরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা অবশ্য সর্বশেষ গবেষণার ফল সম্পর্কে অবগত নন৷ তাই তিনি এখনো মনে করেন, ‘‘কীটনাশকের কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিকের কারণে নয়, শিশুদের মৃত্যু হয়েছে খালি পেটে লিচু খাওয়ার কারণে৷ খালি পেলে শিশুরা লিচু খেলে এক ধরনের বিষক্রিয়া হয়৷ সেই কারণে খালি পেটে লিচু খাওয়া ঠিক নয়৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা নির্ধারিক মাত্রায় লিচুতে কীটনাশক ব্যবহারের পরামার্শ দেই৷ এটা কোনোভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়৷ আর এনডোসালফান নামে কোনো কীটনাশক ব্যবহার হয় কিনা, তা আমি বলতে পারব না৷''
এএফপি-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও লিচু বাগানে ‘অ্যাকিউট এনসেফালাইটিস সিনড্রোম' বা এইএস-এ আক্রান্ত হয়ে একইরকম প্রাণহানি হয়েছিল৷ চিকিৎসাবিষয়ক ব্রিটিশ সাময়িকী ল্যানচেটে প্রকাশিত এক গবেষণামূলক প্রবন্ধে দাবি করা হয়, ভারতের ঐ বাগানে ফলের বীজ ও শাঁসে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া বিষক্রিয়ায় প্রাণহানি হয়েছে৷'
‘অ্যামেরিকান জার্নাল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন'-এর প্রেসিডেন্ট ড. প্যাট্রিসিয়া এফ. ওয়াকার ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে শিক্ষার বিস্তার ও কীটনাশক ব্যবহারের ওপর নজরদারি জোরালো করার কথা বলেন৷