রাশিয়ার সস্তা তেলই বাঁচিয়ে দিলো ভারতকে

একটা সময় ছিল, যখন ভারতে লাগাতার ১২ দিন ধরে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বেড়েছিল৷ সবমিলিয়ে দিন পনেরোর মধ্যে সম্ভবত ১৪ বার তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল৷ তেলের দাম লিটারে একশ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল৷ তারপর পেট্রোল-ডিজেলের সেঞ্চুরি নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ও মিডিয়ায় কম আলোচনা হয়নি৷ এমনও আলোচনা শুরু হয়েছিল, পেট্রোল-ডিজেলের দাম নিয়ে সরকার পুরো টেন্ডুলকরের ফর্মে ব্যাট করছে৷

এই সমালোচনা যখন প্রবল হচ্ছে, তখনই এক ধাক্কায় পেট্রোল, ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি সাড়ে নয় টাকা কমিয়ে দেয় সরকার৷ ফলে দিল্লিতে এখন পেট্রোল পাওয়া যায় লিটারে ৯৬ টাকার সামান্য বেশি দামে৷ এমন নয় যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল৷ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেনি, বরং ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর তা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল৷

তা সত্ত্বেও সরকার যে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে তার কারণ রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল পাওয়া৷ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপিজির ক্ষেত্রে ভারত তার চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আমদানি করে৷ ভারত এতদিন তেল-গ্যাসের বেশিরভাগটা কিনত মধ্যপ্রাচ্য থেকে৷ ৫২ দশমিক সাত শতাংশ এখান থেকেই আসত৷ ১৫ শতাংশ আসত আফ্রিকা থেকে এবং অ্যামেরিকা থেকে ১৪ শতাংশ৷ মাত্র দুই শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে আসত৷

এই পরিস্থিতির রাতারাতি বদল হয়ে গেল ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর৷ ইউরোপ রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কেনা কমিয়েছে, রাশিয়াও তাদেরকে কম তেল ও গ্যাস সরবরাহ করছে৷ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাকি দেশগুলিতেও রাশিয়ার তেল ও গ্যাস অনেক কম যাচ্ছে বা যাচ্ছেই না৷ রাশিয়ার থেকে তেল এখন মূলত নিচ্ছে ভারত ও চীন৷ আমরা জানি, অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ খুবই নীরস৷ কিন্তু প্রকৃত অবস্থা বুঝতে গেলে এই হিসাবের দিকে তাকানোটাও খুবই জরুরি৷

২০২১ সালে এপ্রিল-মে মাসে রাশিয়া থেকে মাত্র ৪৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের তেল কিনেছিল ভারত৷ আর ২০২২-এ শুধু মে মাসেই ১৯০ কোটি ডলারের তেল কিনেছে ভারত৷ আগে বছরে চাহিদার মোট দুই শতাংশ রাশিয়া থেকে আসত৷ এবার এপ্রিল-মে মাসে চাহিদার ১০ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে এসেছে৷ যত সময় গড়াচ্ছে, ততই রাশিয়া থেকে তেল আনার পরিমাণও বাড়ছে৷ কারণ রাশিয়া সস্তায় তেল দিচ্ছে৷

কতটা সস্তা? এনিয়ে ভারত সরকার মুখ খোলেনি৷ তবে আন্তর্জাতিক স্তরের হিসাব হলো, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে দামে তেল কেনে ভারত, তার তুলনায় ব্যারেল প্রতি প্রায় ২০ ডলার বা তারও বেশি ছাড় দিচ্ছে রাশিয়া৷ তাই ভারত এখন যে সব দেশ থেকে তেল কেনে সেই তালিকায় দুই নম্বরে উঠে গেছে রাশিয়া৷ আগে সৌদি আরব ছিল দুই নম্বরে৷ এখন তারা তিন নম্বরে আছে৷ এক নম্বরে আগের মতোই ইরাক আছে৷

রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ তেল আসার ফলে দুইটি সুবিধা পাচ্ছে ভারত৷ এক, তাদের তেল কেনার খরচ কমেছে৷ ফলে কেন্দ্রীয় সরকার সাম্প্রতিক সময়ে তেলের দাম বিশেষ বাড়ায়নি, বরং কমিয়েছে৷ দুই, ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে টান পড়েনি৷ ভারতের কাছে এখন যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আছে, ফলে সেদিকে চিন্তার কোনো কারণ নেই৷ আর রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত এই যে তেল কিনছে, তা অ্যামেরিকা ও ইউরোপের আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়েই কিনছে৷ বাইডেনের পরামর্শদাতা ভারতে এসেছেন, ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান ভারতে এসেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী জার্মানিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে গেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর অ্যামেরিকা গেছেন৷ সব জায়গায় রাশিয়া থেকে তেল কেনার প্রসঙ্গ এসেছে৷ কিন্তু ভারত জানিয়ে দিয়েছে, তারা রাশিয়া থেকে তেল কিনবে৷ ভারতের বক্তব্য ছিল, ইউক্রেনে হামলার পরও ইউরোপ রাশিয়া থেকে একদিনে যে পরিমাণ তেল ও গ্যাস কিনছে, সেই পরিমাণ তেল ভারত সারাবছর ধরেও রাশিয়ার কাছ থেকে কেনে না৷ তাহলে কেন ভারতের ক্ষেত্রে আপত্তি তোলা হবে৷

সাধে কি আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতে এসে জয়শঙ্করকে অনুরোধ করেছিলেন, ঢাকাও যাতে সস্তায় তেল কিনতে পারে, সেই রাস্তা বাতলে দিক দিল্লি৷ তিনি এটাও জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে তাদের উপর চাপ অত্যন্ত বেশি৷ তাই তারা ভারতের সাহায্য চাইছেন৷ একেবারেই ভুল কথা বলেননি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷ কারণ, ইউরোপ, অ্যামেরিকার চোখরাঙানিকে ভারত যে ভয় না পেয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বাড়িয়ে যাচ্ছে, তার কারণ হলো, আয়তনে, প্রভাবে ভারত অনেকটাই বড়৷ ভারতের বিশাল বাজার ধরতে সব দেশের কোম্পানি উদগ্রীব৷ ভারতের বাজার হারালে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি রীতিমতো বিপাকে পড়বে৷ অস্ত্র থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য- সবকিছুর ক্ষেত্রেই ভারতের বাজার তাদের কাছে খুবই লোভনীয়৷ সেজন্য ভারত এই চাপকে উপেক্ষা করতে পারে৷ বাংলাদেশ পারে না৷

আর রাশিয়ার সস্তা তেলই বাঁচিয়ে দিলো ভারতকে৷ না হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো এখানেও তেলের দাম আকাশছোঁয়া হতো৷ তার প্রভাব সব জিনিসের উপর পড়ত৷ যুদ্ধের ফলে ভারতেও মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে৷ তবে তা সাত শতাংশের সীমার মধ্যে আছে৷ ইউরোপ ও অ্যামেরিকার থেকে ভালো অবস্থা ভারতের৷ তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যতই সমালোচনা হোক না কেন, ভারতের মানুষ যুদ্ধের বাজারে মস্কোর সঙ্গে দিল্লির এই বন্ধুত্ব নিয়ে কোনো আপত্তি জানাচ্ছে না৷ বরং তারা এখন স্বস্তিতে, তেলের দাম গত প্রায় ৯০ দিন ধরে বাড়েনি যে৷