1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

জন্ম থেকেই জ্বলছি !

হারুন উর রশীদ স্বপন
১২ আগস্ট ২০২২

বাংলাদেশে জ্বালানি তেল আসলে আসলেই একটি মুর্তিমান জ্বালা৷ এই তেলের আগুনে জ্বলে সব কিছু৷ এর জ্বলুনি এত বেশি যে কাঁচা মরিচের ঝালও বেড়ে যায়৷ বেড়ে যায় ডিমের দাম৷ এমনকি চটপটিরও৷

https://p.dw.com/p/4FSdM
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এত দিকে প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রভাব কতটা হতে পারে তা কী সরকার আগে মেপে দেখেছে?
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এত দিকে প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রভাব কতটা হতে পারে তা কী সরকার আগে মেপে দেখেছে?ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

সম্পর্ক থাকুক আর নাই থাকুক একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই হলো৷ সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে৷

তাই জ্বালানি তেলের দাম যেন বাজারদরের ব্যারোমিটারে পরিণত হয়েছে৷ কিন্তু এই ব্যারোমিটার সব সময় ঊর্ধ্বগামী৷ এই ধরনের ব্যারোমিটার শুধু বাংলাদেশেই আছে৷ বাড়বে কিন্তু কমবে না৷ একবার বাড়লে আর কমার কোনো ইতিহাস নেই৷

সর্বশেষ পরিস্থিতি দিয়েই শুরু করি৷ এবার বাংলাদেশে  জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর হার নজীরবিহীন৷ অতীতে এত দাম আর কখনোই বাড়েনি৷ তাই বাজারে এর আঁচও পড়তে শুরু করেছে নজীরবিহীনভাবে৷ সকালের নাস্তার ডিম অনেক আগেই ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কেউ কেউ৷  কারণ ১২০ টাকা ডজনের ডিম এক লাফেই ১৩৫ টাকা হয়েছে৷  অচিরেই একটি ডিম নাকি ১৫ টাকা হবে বলে ডিম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন৷ আর খাওয়ার তেলের দাম শতকরা ২০ ভাগ বাড়ানোর আবদার করেছেন ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা ৷ আর আবদারের পরই বাজারে ভোজ্য তেলের সংকট শুরু হয়েছে

বাস ভাড়াতো  জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহান বিআরটিএ বাড়িয়ে দিয়েছে৷ আসলে বাস মালিকেরা অপেক্ষায় থাকেন৷ মওকা পেলেই হলো৷ সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া তারা সব সময়ই নেন৷ এখন তার ওপরেই আবার বাড়ানো হয়েছে৷ বাসযাত্রীরা দুই-একদিন হইচই করেন, তারপর মেনে নেন৷

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় একমাত্র কাঁচা পেঁপে ছাড়া আর সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে৷ চালের দাম বেড়েছে৷ ৫২-৫৫ টাকার নিচে বাজারে এখন আর কোনো চাল পাওয়া যায় না ৷ মাছের দাম, মাংসের দাম বেড়েছে৷ ডাল, চিনি ধেকে শুরু করে হলুদ মরিচ কোনোটির দামই বাড়তে বাকি নেই৷ শুনেছি পিঁয়াজের বাজারও নড়াচড়া করছে৷

এসবই সাময়িক প্রভাব৷ সামনে আরো দুর্গতি আসছে৷ মানুষের মেজাজও চড়ছে৷ হিসাব মিলাতে পারছেন না৷ আর কোথায় যে মাসের বাজেট কমিয়ে খরচ ঠিক রাখবে তা ঠিক করতে পারছেন না৷ ফলে মেজাজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে৷ ছোট বেলায় পাটিগণিতের শতকরা হিসাবের অংকও দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না৷ কারণ পরিস্থিতি যা তাতে শতকরা হিসাবও উল্টে যাচ্ছে৷ কারণ খরচ একই রাখতে চালের শতকরা হারে  খাওয়া কমাতে কমাতে কোনো কোনো বেলাই বাদ দিয়ে দিতে হচ্ছে৷

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সাথে অন্যসব কিছুর দাম বাড়ার একটি "শেকল সম্পর্ক” আছে বলে জানান অর্থনীতিবিদেরা৷  জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে বাসের ভাড়া বাড়ে, পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ে৷ কৃষি পণ্য উৎপাদনের খরচ বাড়ে ৷ পরিবহন খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে৷ কারণ পণ্য তো পরিবহন করে আনতে হয়৷ পণ্য উৎপাদন খরচও বাড়ে৷ ফলে দামের ক্ষেত্রে ডাবল প্রতিক্রিয়া দেখা যায়৷ কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রেও তাই৷ পরিবহন ও উৎপাদন খরচ দুই দিকেই বাড়ে৷ তার ওপর আবার বিদ্যুৎ থাকে আসা যাওয়ার  মধ্যে৷ শিল্প, তৈরি পোশাক সবখানেই উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে৷ তাই  জ্বালানি তেল যেন দুইধারি তলোয়ার যার দুই দিকে কাটে৷ আর তার এই দুই দিকে কাটার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর৷  জ্বালানি  তেলের তাপে তারা পুড়তে থাকেন৷

তো যে  জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে এত দিকে প্রতিক্রিয়া হয় তার প্রভাব কতটা হতে পারে তা কী সরকার আগে মেপে দেখেছে? লাভ করতে গিয়ে কত দিক দিয়ে ক্ষতি হবে তা কি পরিমাপ করে দেখেছে? না সাধারণ মানুষের ওপর দিয়ে যাবে বলে তাদের এ নিয়ে ভাবনা নেই৷

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য  জ্বালানি   তেলে আগুন জ্বালার পর এখন বলছেন এর প্রভাব তারা মূল্যায়ন করে দেখছেন৷ আমরা জানতাম কোনো সিদ্ধান্তের কী প্রতিক্রিয়া বা লাভ-ক্ষতি হবে আগেই মূল্যায়ন করতে হয়৷ তবে অর্থমন্ত্রীর কৌশলটি বেশ ভালো(!)৷ কাউকে পিটিয়ে তিনি ব্যাথা পান  কী না- সেভাবেই প্রতিক্রিয়া দেখার মত৷
এখন বাহাস হচ্ছে বিপিসির লাভের টাকা নিয়ে৷ কেউ বলছেন বিপিসির লাভের টাকা কোথায় গেল৷ সেই টাকা দিয়েইতো তেলের দাম না বাড়িয়ে সামাল দেয়া যেত৷ বুধবার সিপিডিও একই কথা বলেছে৷ তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, গত মে পর্যন্ত শেষ আট অর্থবছরে ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিপিসি৷ সরকার জ্বালানি তেলে প্রায় ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের কর নেয়৷ বিপিসির কাছ থেকে প্রতিবছর লভ্যাংশ নিচ্ছে৷ উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে বিপিসির তহবিল থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে সরকার৷

হারুন উর রশদি স্বপন, ডয়চে ভেলে
হারুন উর রশদি স্বপন, ডয়চে ভেলেছবি: Harun Ur Rashid/DW

এরপর বিকেলে আবার সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা জবাব দিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ৷ তিনি বলেছেন,  ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত জ্বালানি খাতে ক্রমাগত লোকসান দিতে হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা৷ এ খাতে ভর্তুকির বিনিময়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে ৪৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা বিপিসিকে দিয়েছে৷ ওই সময়ে আরো প্রায় আট হাজার ১২৭ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল, যা পরে বিপিসির মুনাফার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়৷

বিপিসির এই হিসাবটি আমার কাছে গোলমেলে ঠেকছে৷ তারা মুনাফার সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলেছে৷ কিন্তু মুনাফার কোনো হিসেব দিচ্ছে না৷ সেটাও জানানো দরকার৷

যাক,  জ্বালানি তেলের নজীরবিহীন দাম বাড়ানোর পরও বিপিসি বলছে এখনো ডিজেলে লিটার প্রতি ছয় টাকা লোকসান হচ্ছে৷ তবে অকটেনে কিন্তু ২৫ টাকা ব্যবসা হচ্ছে৷ আমার কথা হলো  বিশ্ববাজারের অজুহাত দেখিয়ে  জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো৷ এখানেতো বিশ্ববাজারে দাম কমলে কখনো কমানো হয়নি৷  শুধু বাড়ানোই হয়েছে৷ আবার কেউ কেউ ইউরোপ অ্যামেরিকার  এখন কোন দেশে  প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম কত তারও তুলনা করেছেন৷  কিন্তু ওই সব দেশে তো প্রতিদিন মূল্য সমন্বয় করা হয়৷ সকাল বিকেলেও দাম কমে- বাড়ে৷  সেই সব দেশের সাথে আমাদের দেশের এখন তুলনা করা হচ্ছে কেন?

বড় হিসাব হলো  জ্বালানি  তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবের হিসাব৷ কিছু টাকা লাভ করতে গিয়ে দেশের মানুষের কতটা ক্ষতি হয় তার হিসাব বের করা৷ কৃষি, শিল্পে কতটা খরচ বেড়ে লোকসানে পড়ে সেটা দেখা৷ সাধারণ মানুষের কতটা খরচ বাড়ে সেটা আমলে নেয়া৷ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট মিলালেই সব হয়ে যায় না৷ মানুষের কাছ থেকে যেকোনো উপায়ে টাকা নিলেই উন্নয়ন হয় না৷ এটা অর্থমন্ত্রী এবং সরকারকে বুঝতে হবে৷

অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন  জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সব কিছুর দাম বাড়ে৷ কিন্তু মানুষের আয় বাড়ে না৷ মানুষের দাম বাড়ে না৷ অর্থনীতির কেন্দ্রে যদি মানুষ না থাকে তাহলে অর্থমন্ত্রীরা সরকারের কোষাগারে টাকা আনার কাজেই ব্যস্ত থাকবেন৷ আর আমরা জন্ম থেকিই জ্বলছি৷ জ্বলতেই থাকব৷