যানজটে ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতিরও
৩ মার্চ ২০১৬২০১১ সালে রাজধানীতে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ইনস্টিটিউশন অফ ইঞ্জিনিয়ারস, বাংলাদেশ (আইইবি)৷ তাদের হিসাবে, সে সময় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা৷ পরের বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে ইউএনডিপি৷ তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো৷ আর সর্বশেষ ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে হিসাব করেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই)৷ তারা দেখায়, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান৷
বিনিয়োগ বোর্ডের হয়ে গবেষণাটি করেছেন উপ-পরিচালক সঞ্চয় চক্রবর্তী৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এই গবেষণা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি৷ তাঁর মতে, ‘‘বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে জেলা শহরগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার৷ সেই সঙ্গে মানুষের ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা কমানো দরকার৷ নতুবা কোনো কিছুতেই সফলতা মিলবে না৷''
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে যানজটের অবস্থা আমরা সবাই জানি৷ এ নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছে, যেখানে যানজটে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টা উল্লেখ করেছেন আপনারা৷ এই ক্ষতিটা কীভাবে নির্ধারণ করেছেন? আর ক্ষতির পরিমাণটাই বা কী রকম?
সঞ্জয় চক্রবর্তী: ঢাকা শহরে ট্র্যাফিক জ্যামের অর্থনৈতিক ক্ষতিটা কী? এটাই ছিল আমার গবেষণার মূল বিষয়৷ ২০১৪ সালে এক বছরে ঢাকা শহরে ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেটা আমি নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি৷ ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা), যা আমাদের মোট জিডিপির ৭ শতাংশ৷ ঐ বছর আমাদের জিডিপির আকার ছিল ১৭ হাজার ৩৮১ কোটি ডলার৷ গাণিতিক একটা হিসাব করেই এই সংখ্যাটা বের করা হয়েছে৷
কাজ করতে গিয়ে কোন কোন বিষয় আপনারা সামনে এনেছেন বা কোন দিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল আপনাদের?
আসলে ট্র্যাফিক জ্যাম কী কারণে হয় – প্রাথমে আমরা সেটা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি৷ এর অনেকগুলো কারণ আছে৷ তবে আমরা যদি মূল কারণগুলো দেখি, তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে, ঢাকা শহরে মানুষ কেন আসতে চায়? মূল বিষয়টা হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়োগ৷ এই তিনটি বিষয়ের কারণে ঢাকা শহরে মানুষ আসছিল, এখনও আসছে৷ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ, অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ ঢাকাতে অবস্থান করছে৷ আমাদের গবেষণায় ছিল, ঢাকা শহরে বাসবাস করা মানুষের এতে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে৷
আপনারা তো শুধু ঢাকা শহর নিয়েই গবেষণা করেছেন, তাই না?
হ্যাঁ, শুধু ঢাকা শহর নিয়েই গবেষণা করেছি আমরা৷
এর সঙ্গে অন্য শহরগুলো, যেমন চট্টগ্রামের ট্র্যাফিক জ্যামের বিষয়টি কি আসেনি? সারাদেশে ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে? এ ধরনের কোনো তথ্য কি আপনাদের কাছে আছে?
বিনিয়োগ বোর্ডের এই ধরনের গবেষণার কোনো পরিকল্পনা নেই৷ তবে একটা জিনিস বলতে পারি যে, মোট জিডিপির ৩৫ ভাগই ঢাকা শহরকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে৷ বাংলাদেশের মোট আয়তন এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার আর ঢাকা শহরের আয়তন ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার৷ অথচ এতটুকু অঞ্চল তৈরি করছে ৩৫ ভাগ জিডিপি৷ প্রাদেশিক সরকার না হওয়াতে ঢাকা শহর একটি মাত্র বড় শহর, যা মানুষের শরীরের হার্টের মতো৷ অর্থাৎ যদি সেটা ‘ফেল' করে তাহলে পুরো শরীরটাই ‘ফেল' করবে৷ যদি ৪-৫টা হার্ট থাকতো, তাহলে একটা হার্ট নষ্ট হলেও অন্যগুলো দিয়ে ‘সার্ভাইভ' করতে পারতাম আমরা৷ ভারতে যেমন প্রতিটি রাজ্যে প্রাদেশিক সরকার আছে৷ ফলে ঢাকায় যখন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তখন পুরো অর্থনীতিই দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
পরিবহন সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব মানুষের কর্মঘণ্টার ক্ষতি একরকম নয়৷ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আর একজন ছাত্রের কর্মঘণ্টার মূল্যের মধ্যে তফাৎ আছে৷ আবার ধরা যাক, সিগন্যালে যখন যানজটের কারণে একটি বাস আটকে থাকে, তখন দেখতে হবে বাসে কত যাত্রী আছে৷ অথবা রাস্তায় কত ট্রাক চলছে...৷ সেক্ষেত্রে প্রতিটি ট্রাকের ক্ষতি আলাদাভাবে বের করতে হবে৷ ফলে এই ক্ষতির পরিমাণ কম-বেশি হওয়ার সুযোগ আছে৷
কোনো গবেষণাই শতভাগ ঠিক – এটা বলার সুযোগ নেই৷ এটা ‘ফোরকাস্টিক মডেল' না, এটা ‘ডিটারমিনেস্টিক মডেল'৷ আমি আমার গবেষণায় বলেছি যে, আমি কোন জায়গা থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়েছি৷ আমি যাদের কাছ থেকে ডেটা নিয়েছি, সেটা আমি উল্লেখ করেছি৷ সেই তথ্যে যদি কোনো ধরনের ‘লুপ হোল' থাকে, তাহলে আমাদের গবেষণাতেও কিছু ভুল থাকতে পারে৷ প্রতিটি রিসার্চেই তাই থাকে৷ তবে এর আগে কোনো গবেষণায় দেখানো হয়নি যে, একজন মানুষ যদি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়, তবে তাতে ক্ষতি কী? ফিলিপাইন্সে এমন একটি গবেষণা হয়, যেটা আমরাও এখানে করার চেষ্টা করেছি৷ একজন মানুষ যদি ২৫-৩৫ বছর বয়সে মারা যায়, তাহলে সে আরো কত বছর বেঁচে থাকলে আমাদের জিডিপিতে কী পরিমাণ ‘আউটপুট' দিত, সেটা আমরা গাণিতিক হিসেব করে দেখিয়েছি৷
আপনারা গবেষণাটা কতদিন ধরে করেছেন?
এটা মূলত বিভিন্ন ‘সেকেন্ডারি ডেটাবেস' থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে৷ প্রায় ৬-৭ মাস ধরে আমি কাজটি করেছি৷
আচ্ছা, এই ক্ষতি থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
আমি আমার গবেষণায় দু'ধরনের পরামর্শ দিয়েছি৷ ঢাকা শহরে মানুষের যে ‘মুভমেন্ট', সেটা ‘অ্যারেঞ্জ' করা৷ তার মানে এই নয় যে, কাউকে বলা আপনি এদিকে যেতে পারবেন না বা ওদিকে যেতে পারবেন না৷ আগে এর ‘অরজিন'-টা খুঁজতে হবে যে, ঢাকা শহরে মানুষ কেন আসে? মূল কারণ হলো, যেমনটা আগে বলেছি – শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়োগ৷ এর বাইরে প্রশাসনিক কিছু বিষয় আছে, যেমন সচিবালয়, উচ্চ আদালত ইত্যাদি৷ সুপারিশে আমরা বলেছি যে, অনেকটা বাধ্য হয়েই মানুষ ঢাকায় আসে৷ এখন যদি আমরা ঢাকা শহরের মতো অন্য বিভাগীয় শহর বা জেলা শহরকে ‘গ্রোথ সেন্টার' হিসেবে ‘ডেভেলপ' করতে পারি, অর্থাৎ শহরগুলোতে যদি সব রকম সুবিধা তারা পায়, পুরো না হলেও ঢাকার কাছাকাছি সুযোগ-সুবিধা থাকে, তাহলেও তারা আর ঢাকায় আসবে না৷ দ্বিতীয়ত, অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে৷ আমাদের মূল জায়গায় হাত দিতে হবে৷ এক্ষেত্রেও বিভাগীয়, জেলা বা উপজেলা শহরগুলোকে ‘গ্রোথ সেন্টার' হিসেব গড়ে তুলতে পারলে ঢাকার উপর চাপ কমানো যাবে৷ আরেকটা হলো ‘ডিজিটালাইজেশন' করা৷ মানুষ যেন ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার কাজ করতে পারে৷ তাহলে রাস্তায় মানুষের ‘মুভমেন্ট' বা যাতাযাত অনেক কমে যাবে৷ এটা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে অনেক উন্নতি হবে৷
সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? আপনি কি সঞ্চয় চক্রবর্তীর সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷