যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ছাত্র মৃত্যু
শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয় হলো যাদবপুর। ছাত্র মৃত্যুর পর এখন তা সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ ঘটনা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় দেশের পাঁচ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ঘটে যাওয়া এক মৃত্যু নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তোলপাড় রাজ্য। পুলিশ সূত্রে খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের ‘এ’ ব্লকের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে ‘কোনও ভাবে’ পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় এক পড়ুয়ার।
পড়ুয়াদের দাবি
হস্টেলের অন্য পড়ুয়াদের দাবি, ৯ অগস্ট, বুধবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তারা ওপর থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পান। তারা দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন এক ছাত্র। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিকটবর্তী এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মৃত্যু হয় ওই ছাত্রের।
ঘনিয়ে উঠেছে রহস্য
এর পর ধীরে ধীরে এই মৃত্যু ঘিরে ঘনিয়ে উঠেছে রহস্য। মৃত ছাত্র হস্টেলের বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, না কি নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে? তদন্তে নেমে খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
গেটে তালা
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বুধবার রাতে মৃত্যুর আগে ওই ছাত্রের আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তেমনটাই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই ছাত্র নাকি বার বার বলছিলেন, ‘‘আমি সমকামী নই।” ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর একটা গেটে তালা পড়েছে।
‘প্রাক্তনীদের মৌরসীপাট্টা’
এরপর পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়ে যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই গোটা ঘটনায় আরও একটি বিষয় সামনে এসেছে। আঙুল উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ‘বেআইনিভাবে’ থেকে যাওয়া প্রাক্তনীদের দিকে। ছাত্রদের একাংশের দাবি, হোস্টেলে ‘র্যাগিং’-এর নেপথ্যে রয়েছেন মূলত তারাই।
ডায়রির পাতা
পড়ুয়া্দের অনেকেই জানিয়েছেন, এই প্রাক্তনীরা প্রায়ই হস্টেলে মত্ত অবস্থায় ঝামেলা করেন। র্যাগিং করেন। আশঙ্কা, ছাত্রের রহস্যমৃত্যুর নেপথ্যেও প্রাক্তনীদের হাত থাকতে পারে। এরই মধ্যে সামনে এসেছে মৃত ছাত্রের ডায়েরিতে লেখা একটি চিঠি। সন্দেহ করা হচ্ছে তার মৃত্যু রহস্যের মোড় অন্যপথে চালিত করতেই এই চিঠির অবতারণা। পুলিশি জেরায় চিঠি লেখার কথা স্বীকার করেছেন ধৃত পড়ুয়া দীপশেখর দত্ত।
নয়জন গ্রেপ্তার
পড়ুয়া মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। এর পর রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই পড়ুয়া মনোতোষ ঘোষ এবং দীপশেখর দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার আরও ছয়জন পড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘র্যাগিং নতুন কিছু নয়’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ঘটা করে তৈরি হয় ‘অ্যান্টি-র্যাগিং’ কমিটিও। এই মর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান ছাত্রছাত্রীদের একাংশ। বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলেছে। বিবৃতি প্রকাশ করে তাঁদের প্রশ্ন, হস্টেলের সুপারের উপস্থিতিতে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল। যাদবপুর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় এআইডিএসও।
পকসো
যাদবপুরের ছাত্রের মৃত্যু মামলায় তদন্তকারী পুলিশ জানিয়েছে তারা পকসো আইনের ধারা জুড়তে পারে। কারণ যাদবপুরের মৃত ছাত্রের বয়স মৃত্যুর সময় ১৮ পূর্ণ হয়নি বলে পরিবার সূত্রে খবর। সে ক্ষেত্রে ওই ছাত্র নাবালক। এবং তার বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের অভিযোগে নাবালকের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনের আইন পকসো জুড়বে বলেই পুলিশ সূত্রে খবর।
কেঁদেই ফেলেন রেজিস্ট্রার
ঘটনার চার দিন পর অবশেষে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু। তিনি ক্যাম্পাসে আসতেই তাকে প্রশ্ন করা হয়, এতদিন কোথায় ছিলেন? ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না কেন? সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েই কেঁদে ফেলেন রেজিস্ট্রার।
কমিশনের নোটিস
সোমবারই ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে নোটিস পাঠায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। স্বতঃপ্রণোদিত এই নোটিসে কমিশন জানায়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনার আগে ডিনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মৃত ছাত্রের সহ-আবাসিকেরা। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
সাবেক উপাচার্যের মত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী এক সংবাদপত্রে কলম ধরেছেন। লিখেছেন, “আমি ইস্তফা দেওয়ার পরেই যাদবপুরে অরাজকতার কালো দিনের সূচনা। আমার মনে হয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় খাপ পঞ্চায়েতের আদলে চলে। সেখানে ‘জিবি মিটিং’ এবং নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের খাতিরে আধিকারিক ও উপাচার্যকে ‘ঘেরাও’ করা দু’টি প্রচলিত ‘রীতি’।”
রেজিস্ট্রারকে তলব
যাদবপুরকাণ্ডে বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু এবং ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কে ডেকে পাঠানো হয় লালবাজারে। সেই মতো রেজিস্ট্রার বিকেলে হাজিরা দিলেও যাননি ডিন। পুলিশ সূত্রে খবর, পড়ুয়ারা ‘ঘেরাও’ করে রাখার কারণে তিনি লালবাজারে যেতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।
উত্তাপ বাড়ছে
বুধবার উত্তপ্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। তৃণমূল ছাত্রপরিষদের সঙ্গে বচসা এবং হাতাহাতি হয় এআইডিএসও-র সমর্থকদের। মৃত ছাত্রের এলাকা বগুলা থেকেও বহু মানুষের প্রতিবাদ মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়।