1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আত্মহত্যার চেষ্টা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন আতিকা রোমা

১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যা অনেক বেড়ে গেছে৷ এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে৷ কিন্তু আত্মহত্যার প্রবণতা কেন তৈরি হয়? কীভাবেই বা এর সমাধান?

https://p.dw.com/p/46rQp
আতিকা রোমা
আতিকা রোমাছবি: Privat

তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আতিকা রোমা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন তার জীবনের গল্প৷ নারীদের স্কুটি (মটর সাইকেল) ট্রেনিংয়ের জন্য তৈরি করেছেন ‘যাবো বহুদূর’ নামে একটি সংগঠন৷ এখন অনেকেরই অনুপ্রেরণা সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও টিম লিডার আতিকা রোমা৷

ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর মহসিন খান ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন৷ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ সালে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে৷ একজন মানুষ কেন এত কঠিন একটা সিদ্ধান্তের দিকে যান?

আতিকা রোমা : একেক জনের প্রেক্ষিত একেক রকম৷ কেউ যখন এমন সিদ্ধান্ত নেন তিনি তখন ভাববার মতো জায়গায় থাকেন না৷ তিনি তখন ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক এর উর্ধ্বে চলে যান৷ ফলে তৃতীয় কারও পক্ষে বোঝা অসাধ্য৷ সম্প্রতি যেটা আমরা দেখলাম, একজনই লাইভে আত্মহত্যা করেছেন৷ এর বাইরেও কিন্তু বেশ কয়েকজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানুষের মধ্যে যে আকাঙ্খা আছে সেটা জোরদার হচ্ছে৷ ভেতর থেকে একটা তাগিদ আসে৷ ও করে ফেলেছে, আমিও করে ফেলি৷ এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো৷   

এই বিষয়গুলো নিয়ে কী আলোচনা করে কোন সমাধান করা যায় না?

এখন তো বৃহৎ আকারে আলোচনা-পর্যালোচনার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে৷ এখন আর চুপচাপ বসে থাকার অবস্থা নেই৷ কারণ আমাদের দেশে এখন ফেসবুক ব্যবহার করে খুব ছোট বাচ্চারাও৷ যদিও ১৩ বছরের আগে এটা ব্যবহারের বিধিনিষেধ আছে, সেটা কেউ মানেন না৷ জন্মের পরই একটা বাচ্চার নামে একাউন্ট খুলে দেওয়া হচ্ছে৷ ফলে কোন বাচ্চার মনেও এটা আঘাত হানতে পারে৷ ছোট কোন অভিমান থেকেও সে বড় স্টেপ নিয়ে নিতে পারে৷ এই জায়গা থেকে আমাদের মানুষকে বোঝাতে হবে, এটার কুফল নিয়ে কথা বলতে হবে৷

‘পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হওয়া এখন সময়ের দাবি’

পারিবারিক বন্ধন, ধর্মীয় শিক্ষা, মূল্যবোধ এগুলো কী ক্ষয়ে যাচ্ছে? আমরা কী অনেক বেশি আবেগ অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি?

পারিবারিক বন্ধন যে আমাদের দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, সেটা আমরা কয়েকটা ঘটনাতে দেখেছি৷ আমার পরিচিত একটা মেয়ে ঝিনাইদহে আত্মহত্যা করেছে৷ তার পুরো বিষয়টাই ছিল পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা৷ মা-বাবা ডিভোর্স৷ তারা দু'জনেই আলাদাভাবে বিয়ে করেছেন৷ মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না, বাবার সঙ্গে তো ছিলই না৷ ফলে এই মেয়েটার নিঃশ্বাস নেওয়ার কোন জায়গা ছিল না৷ একইভাবে মহসিন সাহেবের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা ছিল৷ আর ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে গোড়ামিতে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠছি, কিন্তু মূল যে ধর্মীয় শিক্ষা সেটার চর্চা আমরা করছি না৷ ধর্মীয় চর্চাটা এখন এত বেশি লোক দেখানো হয়ে গেছে যে, আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে৷ 

কেন আমরা জীবনকে ভালবাসতে বা উপভোগ করতে পারছি না?

এরা পারছে না যে কারণে, আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হচ্ছে না৷ মন খুলে সে পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছে না৷ চাকরি নেই, চলার মতো টাকা নেই, কোন সম্পর্ক ছিল, সেটা ভেঙে গেছে৷ ফলে সব মিলিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কিছু হাত দরকার হয় সেটা বন্ধু হতে পারে, বাবা মা হতে পারে সেটা তো হচ্ছে না৷ এমন কেউ থাকলে পরিস্থিতির উত্তরণ হতে পারে৷

আপনিও এক সময়, এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? কেন আপনাকে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল?

আমি তখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলাম৷ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম৷ একই সময় একটা সম্পর্ক ছিল, সেটা ভেঙে যাচ্ছিল৷ মা-ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল৷ সব মিলিয়ে আমার ডানে, বামে, সামনে, পিছনে কিছু ছিল না৷ তখন আমার কাছে যেটা মনে হয়েছিল, মৃত্যুই মনে হয় একমাত্র সমাধান৷ সেই জায়গা থেকে আমি তিনবার সিরিয়াস চেষ্টা করেছিলাম৷ দুইবার বাইরের মানুষ বাঁচিয়েছে, আর একবার আমার মা টের পেয়ে গিয়েছিলেন৷ এই প্রবণতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে৷ জীবনে একবার না একবার এই ইচ্ছেটা হয়৷ তখন আমার মা প্রচণ্ডরকম সাপোর্ট দিয়েছিলেন৷ তখন আমি আমার সমস্যাগুলো তাকে খুলে বলেছিলাম৷ তখন সে আমাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেছে৷ খুব নামকরা কিছু মনোবিদের কাছে আমি গেছি৷ তাদের কাউকে আমার পছন্দ হয়নি৷ তারা অনেক বেশি জাজমেন্টাল৷ তখন আমি নিজেই খুঁজে কলকাতার একজন বিখ্যাত মনোবিদের কাছে যাই৷ উনি টানা ছয় মাস আমাকে ট্রিটমেন্ট দিয়েছিলেন৷ এই সময়টা আমি ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ করেছি৷ আমার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে উনি অনেকবার সিটিং দিয়েছেন৷ যে কথাগুলো আমি মাকেও বলতে পারিছিলাম না, সেগুলোকে উনার সঙ্গে শেয়ার করেছি৷ উনি কৌশলে সেটা হ্যান্ডেল করেছেন৷ আসলে আমাদের পরিবার এই সাইকো সোশ্যাল সাপোর্টটা দিতে চান না৷ এটা দেওয়াটা জরুরি৷

আপনি কীভাবে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন?

একবার শ্যামলী ফুটওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ দেখছিলাম বড় কোন বাস বা ট্রাক আসে কিনা? তখন আমি লাফ দিয়ে ওই গাড়ির নিচে পড়তে চেয়েছিলাম৷ তখন দূর থেকে একজন বয়স্ক লোক আমাকে ফলো করছিলেন৷ তিনি বুঝেছিলেন আমার কোন সমস্যা হয়েছে৷ শেষ মুহূর্তে তিনি এসে আমার হাতটা চেপে ধরেন৷ আরেকবার আমি কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়েছিলাম৷ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷ ঠিক শেষ মুহূর্তে যখন ট্রেনটা এসে পড়ল, আমি ঝাঁপ দেবো, ঠিক তখনই একজন নারী পুলিশ আমার হাতটা টান দিয়ে আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরেছিলেন৷ এই চেপে ধরার মধ্যে এমন মায়া ছিল যে, মনে হচ্ছে একজন মা তার সন্তানকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছেন৷ এটা এখনও আমি ভেবে শিউরে উঠি৷ আর শেষবার অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে বাড়িতেই চেষ্টা করেছিলাম৷ মা তখন টের পেয়ে ডাক্তার ডেকে ওয়াশ করে৷ আরও কি যেন করেছিল, তাতে আমি বেঁচে গিয়েছিলাম৷

আপনি কী তখন এই বিষয়গুলো কারো সঙ্গে শেয়ার করেছিলেন? কেউ কী আপনার পাশে এসে দাঁড়ায়নি?

না, তখন তো আমি কারো সঙ্গেই শেয়ার করতাম না৷ তখন নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম, গুটিয়ে রাখতাম৷ এখন যেমন কোন কিছু হলে ফেসবুকে লিখি বা কোন বন্ধুকে ফোন করে বলি৷ আমার খুব বেশি সমস্যা হলে আমার যে ভারতের মনোবিদ তার সঙ্গে শেয়ার করি৷ তাকে মেইলে লিখি, একটা কনভারসেশন হয়৷ আলোচনা করে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়৷

আপনি যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেন, তখন কী আপনার মধ্যে কোন অনুশোচনা বা অনুতাপ কাজ করেছে?

ঠিক অনুতাপ না৷ আমার মনে হয়েছে বেঁচে থাকতে হবে৷ সংকীর্ণ ভাবে না, বৃহৎভাবে জীবনটাকে দেখতে হবে৷ আমি স্বাভাবিক হওয়ার পর একেবারেই নতুন মানুষ৷ আমি মনে করেছি, মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য কাজ করব৷ আগে তো প্রেম, বাড়ির লোকের সঙ্গে সম্পর্ক এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ এখন আমি সামগ্রিক একজন মানুষ৷ সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় সমাজ আমাকে পজেটিভলি গ্রহণ করেছে৷ সবাই কিন্তু বিষয়টা জানে৷ আর সবচেয়ে বেশি আমাকে যে মানুষটা সাহস জুগিয়েছে তিনি হচ্ছেন আমার মা৷

পশ্চিমা বিশ্বে আমরা দেখি প্রত্যেকেই মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে কাউন্সিলিং নেন৷ আমাদের এখানে এটা কেন নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়? 

ছোট বেলা থেকে আমরা শুনে আসছি, মানসিক চিকিৎক মানে পাগলের ডাক্তার৷ এক কথাতেই শেষ৷ আমরা যেমন জ্বর হলে ওষুধ খায়, তেমনি এটাও একটা রোগ৷ তবে ১০ বছর আগে যে পরিস্থিতি ছিল, এখন তার চেয়ে ভালো হয়েছে৷ পারিবারিক লোকজন যদি একটু সাপোর্টিভ হয় তাহলে কিন্তু কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়৷

আমরা যদি মানবিক সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে আরও যত্নশীল হই, তাহলে কী এই প্রবণতা কমতে পারে?

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি আমার কাছে মনে হয়, আগে যেমন মূল্যবোধের জন্য লেখাপড়া হতো, এখন নাম্বারের জন্য লেখাপড়া হয়৷ এখন মূল্যবোধটা ভীষণভাবে কম দেখি৷ সামগ্রিকভাবে আমরা অসৎ হয়ে গেছি৷ আমরা ঘুসখোর হয়েছি, চরিত্রের যতগুলো খারাপ দিক আছে, যেগুলো মানুষকে ধ্বংস করে আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাটাই তেমন হয়ে গেছে৷ যে বাবা ঘুস খায়, সে তো আর বাচ্চাকে মূল্যবোধের কথা বলতে পারে না৷ করোনার কারণে দুই বছর ঘরে বন্দি থাকার প্রভাবও বেশি করে পড়ছে৷ 

আপনি তো সড়ক জয় করা একজন সাহসী নারী বাইকার৷ এখন আপনাকে অনেকেই অনুসরণ করে৷ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী হবে?

জীবনটাকে ভালোবাসতে হবে৷ নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবার আর কিছু নেই৷ জীবনটাকে একভাবে না হলে, অন্যভাবে ভাবতে হবে৷ জীবনটাকে সামগ্রিক করতে হবে৷ পারিবারিক বন্ধনটা দৃঢ় হওয়া এখন সময়ের দাবি৷

আপনি কী এই বিষয়টি নিয়ে সামনের দিনে কোন কিছু করার পরিকল্পনা করেছেন বা কিছু শুরু করেছেন?

আমার সঙ্গে অনেকেই তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন৷ আমি কিন্তু খুব ভালো শ্রোতা৷ এটা আমি কলকাতার মনোবিদের কাছ থেকে পেয়েছি৷ সবকিছু শোনার পর আমার পক্ষে যতটুকু পরামর্শ দেওয়া সম্ভব, সেটা দেই৷ প্রয়োজনে পরিবারের সঙ্গেও কথা বলি৷ অনেককে চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করি৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই, আমি যখন যাবো বহুদূর চালু করলাম তখন একটা মেয়ে তার বিবাহিত জীবন নিয়ে সুইসাইডাল হয়ে আমার কাছে আসে৷ তখন আমি ওকে বলি, সকালে আমাদের এখানে এসে ট্রেনিং দিবা, অফিস শেষ করে আবারও এখানে আসবা৷ কিছুদিন সে আমাদের সঙ্গে মিশে তার চিন্তাই পরিবর্তন হয়ে গেল৷ এখানে এভাবে অনেককেই করেছি৷ তাদের সঙ্গে আমি হেসেছি, কেঁদেছি৷ এতে অনেকেরই চিন্তার পরিবর্তন হয়েছে৷

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷