1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মাদকাসক্ত আর মানসিক চিকিৎসা একসঙ্গে হচ্ছে, এটা ঠিক না’

২০ নভেম্বর ২০২০

মানসিক চিকিৎসার নামে দেশে কি হচ্ছে? মানসিক রোগীদের কি সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে? ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মেহেতাব খানম বলেছেন, দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসা সঠিক পদ্ধতিতে হচ্ছে না৷

https://p.dw.com/p/3lbrt
মানসিক হাসপাতাল
ছবি: bdnews24.com

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে মাদকাসক্ত আর মানসিক রোগের চিকিৎসা একসঙ্গেই হচ্ছে৷ এটা একেবারেই ঠিক না৷ দু'টো পুরো আলাদা চিকিৎসা৷

ডয়চে ভেলে : আপনি তো নানা ধরনের সমস্যার কথা শোনেন এবং প্রশ্নের উত্তর দেন৷ এখানে মানসিক রোগ নিয়ে কি মানুষ প্রশ্ন করেন?
অধ্যাপক ড. মেহেতাব খানম : হ্যাঁ৷ মানসিক রোগ নিয়েও প্রশ্ন করেন, মানসিক সমস্যা নিয়েও প্রশ্ন করেন৷ রোগ আর সমস্যাকে আমাদের আলাদা করে বুঝতে হবে৷ সমস্যা হল, আমি জীবনে চলছি, কিন্তু রোগের শিকার না হলেও আমি হয়ত অনেক নেতিবাচক আবেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি৷ কখনও রাগ হচ্ছে, কখনও ভয় লাগছে, কখনও কোন দুশ্চিন্তায় ভূগছি, কখনও অসহায় বোধ করছি৷ জীবনে চলার পথে অনেক ঘটনা ঘটে তার প্রেক্ষিতেই এই আবেগগুলো তৈরি হচ্ছে৷ যেটার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা সবার থাকে না৷ আমরা যদি খুব রাগ করে ফেলি, সেক্ষেত্রে আমাদের অসুস্থতার জায়গায় না গেলেও মানসিক বিষন্নতায় ভুগি৷ আবার মানসিক রোগের শিকার ​​ যারা হয়েছেন তারাও কল করছেন৷ তারাও সেবা নেওয়ার চেষ্টা করছেন৷

কী ধরনের মানসিক রোগের কথা মানুষ বলেন?
অনেক ধরনেরই রোগের কথা বলেন৷ অনেক ধরনের মানসিক রোগ আছে যারা বাস্তবে থাকেন না৷ কারো যদি সাইক্রেটিক এপিসোড থাকে৷ এটা হচ্ছে যারা বাস্তব চিন্তার বাইরে একেবারে অলীক চিন্তা করছেন৷ তারা নিজেকে হয়ত এমন বড় কিছু ভাবছেন সেটা হয়ত সত্যিকার অর্থে ঠিক না বা বাস্তবে ঘটছে না৷ তারা হয়ত একা একা কথা শুনছেন, যেটা হয়ত কেউ বলছে না৷ অনেক কিছু তারা দেখতে পান অথচ যেটার কোন অস্তিত্ব নেই৷ এমন অবস্থায় তারা কিন্তু ফোন করতে পারেন না৷ কিছু ফোন এসেছে, যারা হয়ত ওষুধ খাওয়ার পর একটু ভালো হয়েছেন৷ আরেকটা সমস্যা হল, আমি বাস্তবে থাকতে পারছি, কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ যেমন একটা রোগ আছে ওসিডি৷ এটার খুব ফোন পাই আমরা৷ এরা বাস্তবতার সঙ্গে থাকে৷ কিন্তু এত বেশি ধোয়াধুয়ি করছে৷ তারা যেভাবে চাইছে সবকিছু ঠিকঠাক থাকতে হবে৷ একটুও এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না৷ তাহলে তারা সেটা সইতে পারেন না৷ নিজেকে অতিরিক্ত পরিস্কার করতে চাইছেন৷ বাথরুমে অনেক সময় ব্যয় করছেন৷ এতে শুধু তাদের জীবন নয়, পরিবারের লোকজনও খুব বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন৷

এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে আপনারা বা মনোচিকিৎসকেরা কী ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন?
আমার অনুষ্ঠানে যেসব মনোচিকিৎসক আসেন তারা শুধুমাত্র একটু বলতে পারেন যে, কার সেবা লাগবে বা কার ওষুধ লাগবে৷ কিন্তু এখানে কোন ওষুধের নাম বা কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে সেগুলো বলা হয় না৷ এগুলো বলতে আমি নিরুৎসাহিত করি৷ কারণ তিনি যদি বলেন আমি ওই চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছি কিন্তু দুই বছর ধরে তার ওষুধ খেয়ে কোন কাজ হচ্ছে না৷ এখানে ওই ডাক্তারের নাম বললে তার জন্য কোন ভালো অনুভূতির সৃষ্টি করবে না৷ তারা শুধুমাত্র সমস্যার কথা বলেন৷ সেখানে মনোচিকিৎসকেরা তার কি ধরনের চিকিৎসা বা সাইকোথেরাপি লাগবে সেটা বলে দেন৷

আপনি কি কখনও এমন কোন বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন যা ডয়চে ভেলের পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়?
এই জায়গাতে আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি৷ এখানে একটু স্ক্রিনিং তো হয়ই৷ আমাদের কাছে ফোন আসার আগে যারা রিসিভ করেন তারা তো কিছুটা স্ক্রিনিং করে আমাদের দেন৷

আপনি তো মাইন্ড এইড হাসপাতালের ঘটনাটি শুনেছেন? এই ধরনের কোন অভিজ্ঞতা কি কেউ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন?
হ্যাঁ৷ এমন কথা কিন্তু আমি প্রোগ্রামের মাধ্যমে না বাইরেও শুনেছি৷ এখন যে সিলগালা শুরু হয়েছে, এটা করে আল্টিমেটলি কিছু হবে না৷ আমি খুব আশাবাদি হতে পারছি না৷ এটা শেকড়ে ঢুকে গেছে৷
আমার অভিজ্ঞতা বলি৷ একজন মা আমাদের ফোন করলেন৷ তিনি খুব কাঁদছিলেন৷ একটা কথা বলে রাখি, যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বা যারা মাদকাসক্ত তাদের কিন্তু এক জায়গায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷ যেটা একেবারেই ঠিক না৷ দু'টো কিন্তু একেবারে পৃথক চিকিৎসা৷
যেটা বলছিলান, ঢাকার বাইরে একটি শহরে তারা বসবাস করেন৷ তার ১৪ বছরের মেয়ের মানসিক সমস্যা৷ সে ক্ষেপে গেলে বাবা-মাকে রক্তাক্ত জখম করে ফেলে৷ ঢাকা থেকে ওই শহরে যাওয়া একজন চিকিৎসককে তিনি মেয়েকে দেখালেন৷ তার পরামর্শে দুই বছর ওষুধও খাওয়ালেন কিন্তু কোন কাজ হলো না৷ পরে তিনি চিকিৎসককে ফোন করলেন৷ চিকিৎসক তাকে ঢাকায় তার ক্লিনিকে নিয়ে আসতে বললেন৷ একদিন তিনি মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় আসলেন৷ ভর্তি করে রেখে যাবেন এমন প্রস্তুতি তাদের ছিল না৷ তা ক্লিনিকে যখন তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন একজন নার্স মেয়েকে বলে চলো তোমাকে হাসপাতাল ঘুরে দেখাই৷ এই বলে মেয়েকে নিয়ে যায় এবং একটি রুমে আটকে ফেলে৷ মেয়েটি যখন বুঝতে পারে তখন তাকে বলা হয়, তার বাবা-মা চলে গেছে তাকে এখানেই থাকতে হবে৷ এক মাসের মতো মেয়েটি ওখানে ছিলো৷ এর মধ্যে বাবা-মাকে মেয়েকে দেখতে দেওয়া হতো না৷ অনেক কান্নাকাটির পর ফোনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হল৷ তখন মেয়েটি বলল, আমাকে যদি তোমরা এখান থেকে বের না কর তাহলে আমি যদি সুযোগ পাই আত্মহত্যা করব৷ আর বের হতে পারলে কোনদিনও বাবা-মায়ের মুখ দেখবে না৷ তখন আমি তাদের বললাম মেয়েকে ওখান থেকে নিয়ে আসতে৷ কারণ ওর আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে৷
পরে মেয়েটিকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আমার কাছে আসে৷ আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, মা চাকরি করেন বলে মেয়েটি অনেকবার হাত বদল হয়েছে৷ কখনও নানীর কাছে, কখনও খালার কাছে বড় হয়েছে৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর কোন সম্পর্কই তৈরি হয়নি৷ তখন মেয়েটি বারবার চলে যেতে চাইত, না দিলে তাদের বাধ্য করার চেষ্টা করত৷ ওর যখন ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে, তখন ওকে এভাবে রাখাতে ওর এটাচমেন্ট ট্রমা হয়েছে৷ ওর মনটা যে আহত হয়েছে, সেটা না ঠিক করে শুধু ওষুধ খাইয়ে এটা ঠিক করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ ফলে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় অনেক ধরনের আক্রমনাত্মক আচরণ হতে পারে৷

বলা হয়, মানসিক হাসপাতালে শুধু পাগলদেরই চিকিৎসা হয়, এটা কি এমন?
আমরা তো পাগল শব্দটা তো বলতেই চাই না৷ পাগল আবার কি? সবাই তো মানুষ৷ তাদের পাগল ডাকার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? আমরা মানুষকে পাগল ভাবছি কেন? যারা একটু অস্বাভাবিক আচরণ করছে তারা কি মানুষ না? তাদের একটা খেতাব হয়ে গেল তারা পাগল? পাগল তো কাউকে বলা উচিৎ না৷ আমাদের সবার মধ্যেই পাগলামি আছে৷ কেউ হয়তো বর্ডার লাইনের ওপারে চলে গেছে৷ তখন তাকে তো আর আমরা মানুষ হিসেবে দেখছি না?

সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন?
আমি আসলে শুধু মানসিক হাসপাতালের দোষ দিতে চাই না৷ এক ধরনের রোগী আছে যারা একদমই ওষুধ খেতে চাই না৷ ওষুধ নিয়ে তাদের কিছু চিন্তা থাকে যে, এর মধ্যে বিষ আছে, আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে৷ তাদের ওষুধে বিশ্বাস করানো কঠিন হয়ে যায়৷ সে জন্যই তাদের মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন পড়ে৷ উন্নত দেশগুলো কিন্তু এখন বলছে, মানসিক হাসপাতালে নেওয়ার চেয়ে কমিউনিটি কেয়ারের বেশি প্রয়োজন৷ পরিবারের বাইরে থাকলে আবার নতুন করে কিছু নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়৷ তারা একাকীত্বে ভুগছে, পরিবারের উপর বিরক্ত হচ্ছে৷ ওখানে কিন্তু জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ বর্তমানে যেভাবে চিকিৎসা হচ্ছে এটা সঠিক পদ্ধতি নয়৷ একটু আগে যে গল্পটা বললাম৷

আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি, সম্পত্তি দখল বা অন্য কোন কারণে স্বজনরাই কাউকে মানসিক রোগী বানিয়ে হাসপাতালে জোর করে ভর্তি করছেন৷ এমন অভিযোগ কী আপনারা পেয়েছেন?
যারা ভেতরে ছিল, তাদের দু'একজনের কাছ থেকে আমি এমন গল্প শুনেছি৷ এটিও শুনেছি, একটি মেয়ে বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছে না, তার পছন্দের কেউ আছে৷ তার জন্য মেয়েটিকে নিয়ে ওখানে ভরে দেওয়া হয়েছে৷

ভেতরের কিছু গল্পের কথা আপনি বলছিলেন৷ তেমন কিছু কি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করা যায়?
আমি যেটা শুনেছি, একটি নিরাময় সেন্টারে কিছু মেয়ে আছে৷ তারা ড্যান্স করছে, মিউজিক চালাচ্ছে৷ তারা আসলে কি মাদকাসক্ত না মানসিকভাবে অসুস্থ তা বোঝা যাচ্ছে না৷ আবার তারা যখন নিচে যায়, তখন ওখানে কেউ আসে৷ তাদের দামি গিফট দিয়ে যায়৷ আমি জানি না, আসলে ওখানে কি হচ্ছে৷ এসব শুনে মনে হয়, অনেক ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ হওয়ার কথা সেখানে৷

আপনি বলছিলেন, এখন যে চিকিৎসা পদ্ধতি, সেটা প্রপার না৷ তাহলে প্রপার উপায়টা কি?
আমাদের এখানে মানসিক চিকিৎসা যারা দিচ্ছেন তাদের সংখ্যাও তো খুবই নগন্য৷ আমি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি বিশ্বাস করি৷ একেবারে ছোট বেলা থেকেই প্রতিরোধের কাজটা করা দরকার৷ তাহলে আমাদের মানসিক রোগীর সংখ্যাও কমে যাবে৷ আমাদের ছোট বেলার অনেক কারণ থাকে যেটা, বড় হলে রোগী বানিয়ে দিচ্ছে৷ চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমি বলব, এখানে অনেক মানুষ লাগবে৷ যা আছে ভীষণ অপ্রতুল৷ একজন ডাক্তার একসঙ্গে অনেক রোগী দেখছেন৷ ফলে রোগী কথা তিনি শুনছেন না৷ আমাদের এমন কোন ইনস্টিটিউট নেই, যেখানে ধরে ধরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে৷

‘তাদের পাগল ডাকার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে?’

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য