1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নামে ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট’

২০ নভেম্বর ২০২০

বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো এখন চলছে মানসিক হাসপাতাল নামে৷ আর এইসব হাসপাতালে চিকিৎসার নাম ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট’৷

https://p.dw.com/p/3lbYH
Bangladesch Dhaka Nervenklinik
ছবি: bdnews24.com

আসলে অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট নির্মম নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়৷ ভুক্তভোগী এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে৷

বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলো এখন চলছে মানসিক হাসপাতাল নামে৷ আর এই এইসব হাসপাতালে চিকিৎসার নাম ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট'৷ আসলে অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট নির্মম নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়৷ ভুক্তভোগী এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে৷

হাসপাতালগুলোতে আবার অ্যাঙ্গার ম্যানেজন্টের জন্য অ্যাগ্রেসিভ ম্যানেজমেন্ট কক্ষ আছে৷ সেইসব কক্ষে মাদকাসক্ত রোগী ও মানসিক  রোগীদের নির্যাতন করা হয়৷ নির্যাতনেরও আছে নানা পদ্ধতি৷ এমনকি হাত-পা বেধে নির্যাতনের অভিযোগও আছে৷

আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যুর পর অবশ্য হাসপাতালগুলো সতর্ক হয়ে গেছে৷ তারা আপাতত অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট-এর নামে নির্যাতন বন্ধ রেখেছে৷ আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও সারাদেশে অভিযান শুরুর পর তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য আপাতত চিকিৎসার নামে নির্যাতন বন্ধ রেখেছে৷ আর যাদের লাইসেন্স নাই তারাও ক্লিনিক আপতত বন্ধ রেখেছে৷

‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট' কারা করে?

এএসপির মৃত্যুর ঘটনায় মাইন্ড এইড হাসপাতালের নয়জনসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিষ্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে৷ মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ওই এএসপিকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ মাইন্ড এইডের পরিচালক ফাতেমা তুজ জোহরা ময়নার কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে পুলিশ৷ তাকে জিজ্ঞাসাবাদকারী তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মৃত্যুঞ্জয় দে জানান, ‘‘তারা মনে করে মারপিট করেই মাদকাসক্ত বা মানসিক রোগীকে ঠিক করতে হয়৷ অনেক সময় অভিভাবকেরাও এতে আপত্তি করেন না৷ রুমগুলো এমনভাবে তৈরি যাতে রোগী আটকে রাখা যায়৷ আর নির্যাতনের দায়িত্ব দেয়া হয় ওয়ার্ডবয়, সুইপার ও আয়াদের৷’’

‘অনেক নিরাময় কেন্দ্রেই চিকিৎসক নেই’

এই ঘটনার পর পুলিশের কাছে ওই হাসপাতাল ছাড়াও অন্য বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে নির্যাতনের অভিযোগ আসছে৷

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এইসব কথিত চিকৎসা কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে সরকারি মানসিক হাসপাতালের চারপাশে৷ শেরে বাংলা নগর মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ২০-২৫টি প্রাইভেট মানসিক হাসাপাতাল রয়েছে৷ একটি চক্র সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ওইসব প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠায়৷’’

তাজুল ইসলাম জানান, ‘‘আমার জানামতে প্রাইভেট মানসিক হাসপাতালগুলোতে নির্যাতন ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা নাই৷ নেই চিকিৎসক বা মনোচিকিৎসক৷'' তার মতে, মানসিক রোগীদের জন্য অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এর জন্য প্রশিক্ষিত মনোচিকিৎসকের দরকার হয়৷ পিটিয়ে বা নির্যাতন করে নয়, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার আধুনিক কৌশল আছে, তা জানতে হয়৷ সেই মানের চিকিৎসক কি প্রাইভেট ক্লিনিকে আছে? আর সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা তেমন হয় না৷ তাদের টান থাকে কীভাবে প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে পয়সা উপার্জন করবে৷ ওইসব ক্লিনিক-এর পিছনে অনেক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক আছেন৷

মাদক নিরাময় কেন্দ্র বনাম মানসিক হাসপাতাল

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ছাড়াও সরকারি পর্যায়ে মানসিক চিকিৎসার জন্য আরো দুইটি হাসপাতাল আছে৷ একটি তেজগাঁও কেন্দ্রীয় মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্র এবং পাবনা মানসিক হাসপাতাল৷ এর বাইরে ঢাকাসহ সারাদেশে ৩৫০টি বেসরকারি মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে৷ শুধু ঢাকায়ই আছে ১০৫টি৷ যারা মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্রের লাইসেন্স নিয়ে অবৈধভাবে মানসিক হাসপাতাল হিসেবে পরিচালনা করছে তারা৷ এইসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বাস্তবে কোনো চিকিৎসক বা মনোচিকিৎসক নাই৷ তারা নির্যাতনের মাধ্যমেই চিকিৎসা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে৷ অধিদপ্তরের পরিচালক নুরুজ্জামান শরীফ জানান, নিরাময় কেন্দ্রের অনুমতি নেয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়, তারপর তারা কার্যক্রম শুরু করতে পারে ৷ তার আগে নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগ আছে অনেক নিরাময় কেন্দ্রেই চিকিৎসক নেই৷ মনোচিকিৎসক নাই৷ মান খুবই খারাপ৷ আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিই৷ মারধর করে চিকিৎসার কোনো বিধান বা নিয়ম নাই৷’’

আর সহকারি পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) ঊর্মি দে জানান, ‘‘আমরা অনেক সময় মারপিট ও নির্যাতনের অভিযোগ পাই৷ কিন্তু কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না৷’’

‘তারা মনে করে মারপিট করেই মাদকাসক্ত বা মানসিক রোগীকে ঠিক করতে হয়’

বেসরকারি পর্যায়ে ১০ বেডের মাদক নিরাময় কেন্দ্রের জন্য সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী বা মনোচিকিৎসক, দুইজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স থাকার কথা বলা হয়েছে৷ আর প্রতিটি বেডের জন্য থাকতে হবে ৮০ বর্গফুট জায়গা৷ বিনোদনের পর্যাপ্ত সুবিধাসহ আধুনিক প্যালজিক্যাল ল্যাব ব্যবস্থা থাকার কথা৷

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, ‘‘মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স পাওয়া নিরাময় কেন্দ্রগুলো শুধু পুনর্বাসনের কাজ করতে পারে৷ কোনো ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রিটমেন্ট করতে হলে তাদের অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হবে৷ কিন্তু অনেকেরই সেই লাইসেন্স নাই৷’’

অভিযানে কিছু হবে?

মাইন্ড এইড হাসপাতালের ঘটনার পর তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকাসহ সারাদেশে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়গনিস্টিক সেন্টারে অভিযান শুরু করেছে৷ তারা ১৭ ধরনের চেকলিস্ট তৈরি করেছে৷ মহাপরিচালক জানান, যারা চেকলিস্ট পূরণ করতে পারবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও একই কাজ শুরু করেছে বলে জানায়৷

বাংলাদেশে এখন সব মিলিয়ে ছয় হাজারের মত বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের রেজিষ্ট্রেশন আছে৷ কিন্তু আবেদন করেছে ১২ হাজার৷ যে ছয় হাজারের লাইসেন্স আছে তার মধ্যে তিন হাজার ডিজিটাল সিস্টেমে নিবন্ধিত হয়েছে৷ বাকিরা এখনো হয়নি৷ এই তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক( হাসপাতাল) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া৷ তিনি জানান, ‘‘এছাড়া মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে যারা লাইসেন্স নিয়েছে সেই নিরাময় কেন্দ্র গুলোও আমরা পরিদর্শন করছি৷''

সারাদেশে অবৈধ হাসপাতাল বা ক্লিনিক চালাতে সহায়তা করছেন অসাধু কর্মকর্তারা৷ কিন্তু পরিচালক দাবি করছেন তারা এরইমধ্যে এরকম বেশ কিছু ক্লিনিক সিলগালা করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে আমরা সর্বোচ্চ লাইসেন্স বাতিল করতে পারি৷ কিন্তু যারা অবৈধ বা ফৌজদারী অপরাধে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর৷’’

‘অনেকেরই সেই লাইসেন্স নাই’

মাইন্ড এইড হাসপাতাল বাস্তবে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে গত বছরের ২২ আগস্ট লাইসেন্স নেয়া একটি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র৷ কোনো মানসিক হাসপাতাল নয়৷ তারা মানসিক হাসপাতাল হিসেবে কাজ করার জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন করেছিল৷ শর্ত পুরণ করতে না পারায় তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় বলে জানান, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মাইনুল হাসান৷ কিন্তু তাতে কী? তারা দিব্যি মানসিক হাসপাতাল দাবি করে ‘চিকিৎসা’ দিয়ে আসছিলো?

তারা ‘মাইন্ড এইড মানসিক এবং মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্র' নামে লাইসেন্স নিলেও সাইনবোর্ড টানিয়েছিলো ‘মাইন্ড এইড, মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট' নামে৷ কেউ বাধা দেয়নি৷ সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম মারা না গেলে হয়তো এই ‘হাসপাতাল' কোনো বাধার মুখেই পড়ত না৷