মোদী সরকারের ১০০ দিন
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪মোদী সরকারের ১০০ দিনের কাজের মূল্যায়ন নিয়ে জনমনে কৌতূহলের সীমা নেই৷ ড. মনমোহন সিং-এর সাবেক কংগ্রেস-জোট সরকারের নীতি পঙ্গুত্ব, আর্থিক নিশ্চলতা এবং উচ্চমহলে দুর্নীতির অভিযোগ কাটিয়ে অর্থনীতির হাল ফিরিয়ে উন্নয়নের চাকায় গতি আনার চেষ্টা করে চলেছেন মোদী৷ আম জনতার উন্নতির সঙ্গে শিল্পমহলের আস্থা ফিরছে৷ ১০০ দিনেই প্রধানমন্ত্রী মোদী শক্ত হাতে হাল ধরে প্রশাসনিক কাঠামো ঢেলে সাজিয়েছেন৷ প্রশাসনকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন৷ কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে আমলাতন্ত্রের আত্মবিশ্বাস৷ একাধিক ক্ষমতা কেন্দ্রের বদলে এককভাবে শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন তিনি৷
এই যেমন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভরতুকি ইস্যুতে উন্নত দুনিয়ার রক্তচক্ষুর পরোয়া না করে ভারতের ভরতুকি নীতিতে অনড় থাকেন মোদী৷ তবু বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি৷ প্রশ্ন উঠেছে দেশের অর্থনীতিকে তিনি কি চাঙ্গা করতে পেরেছেন? পারলে কতটা? রাজস্ব ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছে বটে, তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে সে বিষয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে৷ মুদ্রাস্ফীতি আগের মতোই আছে৷ জাতীয় প্রবৃদ্ধি গত ১০০ দিনে বেড়েছে খুবই সামান্য৷ তবে মোদীর ১০০ দিনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোডম্যাপে রয়েছে বিদেশি লগ্নি টানার জন্য পরিকাঠামো ক্ষেত্র খুলে দেয়া, বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি ২৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশ করতে বিমা বিল সংসদে পাশ করানো এবং পণ্য পরিষেবা কর চালু করা ইত্যাদি৷ হালে জাপানে গিয়ে ৩,৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের লগ্নি প্রস্তাব ঝুলি ভরে এনেছেন মোদী৷ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটা মোদীর সাফল্যের সূচক৷ ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়৷
১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদীর প্রথম ভাষণে সকলের নজর কেড়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ মুক্ত মোদীর নতুন ভাবমূর্তি, যেটা কলঙ্কিত হয়েছিল ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায়৷ সেই সাম্প্রদায়িক খোলস ঝেড়ে ফেলে সব মানুষের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তিনি৷ এটাই মোদীর সেরা কৃতিত্ব৷ তাঁর ভাষণে বিভেদকামী একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে গেছেন সামাজিক ইস্যু নিয়ে৷ ভারতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের বিকাশ এবং স্বশক্তিকরণের কথা বলেছেন৷ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবাইকে যুক্ত করার জন্য ‘জন ধন যোজনার' কথাও বলেছেন, যেখানে দেশের সব পরিবারের জন্য থাকবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট৷ এই ভাষণের ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে দুই লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব হয়েছে৷ অর্থাৎ, ঋণের জন্য আর মহাজনদের কবলে পড়তে হবে না৷ গরিব চাষীদের ঋণের দায়ে বেছে নিতে হবে না আত্মহত্যার পথ৷ ঋণ দেবে ব্যাংক৷ এর ফলে মোদীর টুপিতে এখন সাফল্যের নতুন পালক৷
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলিকে সঙ্গে নিয়ে চলার বার্তা দেয় মোদী সরকার, যার প্রশংসা হয় সর্বস্তরে৷ তাতে সাড়া দিয়ে প্রতিবেশী সব দেশ মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল৷ কিন্তু কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে দিল্লির আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানি হাই-কমিশনারের বৈঠকের জেরে সেই সুরটা যেন কেটে গেছে৷ বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জিইয়ে রাখতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর তাৎপর্যবাহী৷ তবে তিস্তা নদীর জলবণ্টন এবং স্থলসীমা চুক্তির বাস্তবায়ন মোদী সরকারের বিদেশ নীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ৷ এ মাসেই মোদী মিলিত হবেন একাধিক বিশ্বনেতার সঙ্গে৷ দিল্লিতে বৈঠক করছেন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, চীনের প্রেসিডেন্ট এবং ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে৷ বলা বাহুল্য, বিশ্ব আঙ্গিনায় তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতের গুরুত্ব যাতে বহাল থাকে, সেটা সুনিশ্চিত করতে চান মোদী৷
বিশিষ্ট রাজনীতির অধ্যাপক উদয়ন বন্দোপাধ্যায় ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মোদীর ১০০ দিনের কাজকর্মের খতিয়ান দিতে গিয়ে জানান, ‘‘মোদী সরকারের মূল অভিমুখ স্পষ্ট নয়৷ তবে উদার বাজার অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নি বাড়ানোর চেষ্টা অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ৷ অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতিতে একটা দোলাচলের পরিস্থিতি রয়েছে৷ ২০ বছর আগে যা ছিল তার সঙ্গে বিশেষ ফারাক নেই৷ কাশ্মীর সমস্যা, গাজায় মানবাধিকার ইত্যাদি ইস্যুতে মোদী সরকার কড়া অবস্থান নেয়নি৷ শিক্ষা ক্ষেত্রে তলে তলে একটা গৈরিকিকরণের চেষ্টা চলেছে৷ কাজেই মোদীর সুশাসন বুঝতে ১০০ দিন যথেষ্ট নয়৷ তার ওপর মোদীর মধ্যে একটা একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা জনকল্যাণের পথে অন্তরায় হতে পারে৷''
১০০ দিনের কাজের নিরিখে অধ্যাপক বন্দোপাধ্যায় মোদী সরকারকে দিয়েছেন দশের মধ্যে অর্ধেকের কম৷ তাই আরো ১০০ দিন অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়৷