সাক্ষাৎকার: কামরুন্নাহার ডানা
৩ জুলাই ২০১৮ডয়চে ভেলে: ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের পদচারণা শুরু হয় কখন থেকে?
কামরুন্নাহার ডানা: আমাদের যাঁরা বড় বোন ছিলেন, তাঁরা তো পাকিস্তান আমল থেকেই খেলেছেন৷ তখন তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতেন৷ পাকিস্তান তো তখন নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখত৷ তারপরও আমাদের বড় বোনেরা বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতেন৷ আমি তাঁদের কয়েকজনকে স্মরণ করতে পারি৷ তাঁরা হলেন – প্রয়াত জিনাত আপা, রাবেয়া খাতুন তালুকদার, কাজী নাসিমা হামিদ, জাহেদা আলী এবং কাজী শামীমা৷ তবে ওনারা কিন্তু খেলেছেন আমাদের দেশ স্বাধীনের আগেই৷ স্বাধীনতার পর আমরা যাঁরা এসেছি, আমাদের পথটা তত মসৃণ ছিল না৷ আমরা তখন এটাকে পেশা হিসেবে দেখিনি৷ আমরা খেলাধুলাকে ভালোবেসেই এখানে এসেছি৷
প্রথম কোন খেলায় নারীরা অংশ নেন?
যদি পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলি, তাহলে প্রয়াত জিনাত আপা, রাবেয়া খাতুন তালুকদার, কাজী নাসিমা হামিদ আপারা মূলত অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিতেন৷ এরপর ব্যাডমিন্টন খেলাটা এলো৷ এটা অবশ্য শীতকালীন খেলা হিসেবে দেখা হতো৷ আমরা তো আমাদের সময় চিন্তাই করতে পারতাম না যে, আমাদের মেয়েরা ফুটবল, ক্রিকেট খেলবে৷ ২০০৩ সালের পর ফুটবলটা শুরু করলাম৷ পরে ২০০৬ সালে আমরা ক্রিকেটটা শুরু করলাম৷
ব্যাডমিন্টনে নারীরা কখন আসেন?
এটা স্বাধীনতার উত্তরকালে৷ তখন বাড়িতে বাড়িতেই এই ব্যাডমিন্টন খেলা হতো৷ অবশ্য প্রতিযোগিতাও হতো৷ আমরা এলাম সত্তরের দশকে৷ মূলত স্বাধীনতার পর নতুন দেশ...৷ তখন আমরা একটা নতুন পতাকা পেলাম, বিভিন্ন ফেডারেশন গঠন হলো, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা তখন শুরু হলো৷ আমি ১৯৭৬ সাল থেকে খেলি৷
আপনি যখন শুরু করেছেন তখন খেলাধুলাতে আসা কতটা কঠিন ছিল?
আমাদের সময়ে বিষয়টা এত কঠিন ছিল না৷ কারণ আমরা যাঁরা খেলাধুলায় এসেছি, তাঁদের পারিবারিক সাপোর্টটা ছিল৷ আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি৷ তবে সামাজিক ‘সাপোর্ট' খুবই কম ছিল৷ কারণ যাঁরা খেলতে আসতেন, তাঁদের খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না কেউ৷ এখন যেমন প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে মেয়েরা খেলছে, তখন তো আর এত মেয়ে খেলত না৷ ফলে, খেলতে যাওয়াটা এত সহজও ছিল না৷ অনেকেই পরিবারের সঙ্গে ফাইট করেছে৷ আমি অবশ্য ভাগ্যবান, কারণ আমরা পরিবার ছিল সাংস্কৃতিকমনা৷ ফলে তাঁরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন৷ তবে আত্মীয়স্বজনরা অন্যভাবে দেখতেন৷ পরে দেখা গেল আমরা যাঁরা খেলাধুলা করেছি, তাঁরাই ভালো আছি৷ আর যাঁরা মাঠে আসেননি, তাঁদের অনেকেই বিপথে গেছে৷
মেয়েদের শর্ট পোশাকে খেলা নিয়ে কি কোনো বাধা-বিপত্তিতে পড়তে হয়েছে?
আমি ব্যাটমিন্টনের কথাই বলি৷ ১৯৭৫ সাল থেকে ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট শুরু হয়৷ আমি শুরু করি ১৯৭৬ সালে৷ তখন আমরা ট্রাউজার পরেই খেলতাম৷ ১৯৭৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন ফেডারেশন কিন্তু নিয়ম চালু করে যে, স্পোর্টস ড্রেস পরেই ব্যাডমিন্টন খেলতে হবে৷ তখন আমাদের শর্ট পোশাক পরে ব্যাডমিন্টন খেলতে হতো৷ এখন কিন্তু অনেককেই দেখি ট্রাউজার পরে ব্যাডমন্টিন খেলছে৷ তখন সরকারও চাইত খেলাধুলা খেলাধুলার পোশাকেই হোক৷ তাছাড়া আন্তর্জাতিক ফেডারেশনও তাই চাইত৷
মৌলবাদীদের বাধার কথা বলছিলেন... এটা কখন আর কোন খেলা নিয়ে?
আমরা খেলাধুলার পোশাক পরেই খেলছিলাম, সেটা বেশ ভালোভাবেই চলছিল৷ এমনকি সুইমিং কস্টটিউম পরেও ৮০ সালে আমেনা মোশারফ পুলে নেমেছেন৷ তাতেও খুব একটা সমস্যা হয়নি৷ তখন এটা নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য ছিল না৷ কিন্তু ২০০৩ সালে যখন প্রথম মহিলা ফুটবল শুরু হলো, তখন হলো বিপত্তি৷ আমি তখন ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা ফুটবল লীগের প্রধান ছিলাম৷ ২০০৪ সালে যখন আমরা প্রথম টুর্নামেন্টের ঘোষণা দিলাম যে, আগামী পরশু থেকে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু, তখন বাধা এলো৷ তখন ৬টা দল ছিল৷ কারণ নারী ফুটবলার তো তখন তৈরিই হয়নি৷ তখন খেলা শুরু হওয়ার একদিন বা দু'দিন আগে শুক্রবার ছিল৷ তখন জুম্মার নামাজের পর মৌলবাদীরা বিরাট একটা জমায়েত করল৷ সেখানে তারা ফতোয়া দিল যে মহিলা ফুটবল শুরু করা যাবে না৷ তারা বলল, ফুটবল ফেডারেশন ঘেরাও করবে৷ পাশাপাশি খেলার দিন কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামও ঘেরাও করবে বলে জানালো তারা৷ এমনকি আমাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল৷ আমি নিজে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম৷ পরিবারও রাজনীতি করত৷ ফলে আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম৷ সবাইকে বোঝালাম, তারা যেন বলে যাতে ফুটবল ফেডারেশন এই টুর্নামেন্টটা বন্ধ না করে৷ তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে৷ কারণ ফিফা থেকে মেয়েদের জন্য যে বরাদ্দ দিত, সেটা তারা বন্ধ করে দেবে সেই ঘোষণা দিয়েছিল৷ পাশাপাশি ছেলেদের জন্য যে টাকা দিত, সেটাও কমিয়ে দেবে৷ আসলে তখন ওটা ওভারকাম করতে পেরেছি কারণ সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছে৷ সেদিন আমরা ওই টুর্নামেন্ট শুরু করতে পেরেছিলাম বলেই আজকে মেয়েরা বিভিন্ন খেলায় অংশ নিচ্ছে এবং অনেকে এর থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে৷
খেলাধুলা থেকে উপার্জন শুরু হলো কবে থেকে?
এখানে খেলাধুলায় আগেও কিছু টাকা পাওয়া যেত৷ তবে সেটার পরিমাণ খুব বেশি ছিল না৷ এর জন্য আনসার ও ভিডিপির একটা বড় সহযোগিতা আছে৷ তাদের এই কৃতিত্বটা দিতেই হবে৷ যখন মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হলো, তখন আনসার থেকে মেয়েদের চাকরি দিয়ে টিম বানানো হলো৷ বিশেষ করে পার্বত্য এলাকার মেয়েদের৷ কারণ ওই এলাকার মেয়েদের একটু হার্ডি কাজ করতে হতো৷ বিশেষ করে পাহাড়ে উঠতে হতো৷ এই কারণে ওদের স্ট্যামিনাও বেশি ছিল৷ ওদের যখন ফুটবল খেলার জন্য চাকরি দেয়া হলো, তখন কিন্তু একটা বড় পরিবর্তন হতে শুরু করল৷ এটা নিয়ে একটা বিপ্লব করতে হয়েছে৷ সেই বিপ্লবের সাক্ষী বা অংশীদার হলাম আমরা৷ কারণ আমরা কাজটা শুরু করেছিলাম৷ এখানে একটা গল্প বলি – তখন ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছিলেন আনোয়ারুল হক হেলাল৷ আমি তাকে নিয়ে গ্রামীণফোন অফিসে যাই৷ কারণ গ্রামীণফোন তখন ক্রিকেটে অনেক বেশি বিনিয়োগ করছিল৷ আমরা সেখানে গিয়ে তাদের নারী ফুটবলে স্পন্সর করতে অনুরোধ করি৷ তখন তারা আমাদের জানায়, এখানে স্পন্সর করলে তাদের অফিসে মৌলবাদীরা হামলা চালাতে পারে, ভাঙচুর করতে পারে৷ ফলে তারা রাজি হয়নি৷ এই পরিস্থিতিতে আমরা শুরু করেছিলাম৷
ছেলেরা না পারলেও মেয়েরা এশিয়া কাপ জিতেছে, বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখেন?
ছেলেরা তো স্বাধীনতার আগেও খেলেছে, পরেও খেলেছে৷ তাদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি৷ এখানে ভারত ৬ বার এশিয়া কাপ জিতেছে৷ তারা কিন্তু ৫৫ বছর মহিলা ফুটবল খেলে৷ এটা আমাদের এক বিরাট প্রাপ্তি৷ তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ছেলেরাও অনেক ভালো করছে৷ তারা এশিয়া কাপ দু'বার পেতে পেতে পায়নি৷ খুব অল্প রানের ব্যবধানে হেরেছে৷ গত ওয়ার্ল্ড কাপেও আমরা ভালো খেলেছি৷ মেয়েদের এই দলটাকে ধরে রেখে চুপচাপ বসে থাকলে হবে না৷ আমাদের পাইপ লাইনে অনেক বেশি খেলোয়াড় দরকার, যেটা নেই৷ এর জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম বাড়াতে হবে৷
ছেলে ও মেয়েদের বেতন বৈষম্য নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কিছু বলবেন?
এখানে দেখতে হবে ছেলেরা কতদিন ধরে খেলছে, কতজন খেলছে৷ সে হিসেবে আমাদের মহিলা ক্রিকেটের সময়কাল খুবই কম৷ তবে আমি আশা করব এখন যে ব্যাপক ব্যবধান আছে, বিসিবি সেটা কমিয়ে আনবে৷ তবে এখনই আমরা বলতে পারি না যে আজ আমরা এশিয়া কাপ জিতলাম বলে মেয়েদের বেতন সাকিব, তামিম, মাশরাফির সমান করে দিতে হবে৷ সেটা কিন্তু ঠিকও না৷
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছেলে-মেয়েদের বৈষম্য কীভাবে দূর করা যায়?
আমি আশা করব – আমাদের প্রতিটি ফেডারেশন ছেলে ও মেয়েদের সমানভাবে সুযোগ দেবে৷ মনে রাখতে হবে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী কিন্তু নারী৷ আমাদের অধিকারও সমান হওয়া উচিত৷ ছেলেরা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, মেয়েরাও যেন সেটা পায়৷ অনেক সময়ই দেখা যায় আন্তর্জাতিক কোনো টুর্নামেন্টে দাওয়াত আসলে সেখানে শুধু ছেলেদের টিম যায়, মেয়েদের টিম যায় না৷ এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক৷
কামরুন্নাহার ডানার সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? জানান আমাদের, নীচের ঘরে৷