ফুটবলেই মুক্তি
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে, আসাম সীমান্তের আলিপুরদুয়ার নারী পাচারের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে কুখ্যাত৷ প্রান্তবর্তী এই জেলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিই এর জন্য মূলত দায়ী৷ এখানকার বাসিন্দারা মূলত আদিবাসী, যাঁদের অন্নসংস্থান হয় স্থানীয় চা বাগানগুলির কুলি-কামিন হিসেবে৷ এদের উপার্জন খুবই কম, ফলে সারা জীবন পরিশ্রম করেও নিজেদের আর্থিক সঙ্গতি বলে এঁদের কিছু তৈরি হয় না৷ ফলে অভাবের তাড়নাতেই এঁদের ঘরের মেয়েরা বেহাত হয়ে যায়৷ আড়কাঠিদের পাল্লায় পড়ে পাচার হয়ে যায় ভিনরাজ্যে৷
‘জবালা’ নামে এক বেসরকারি সেবা সংগঠন এই নারী পাচার চক্রের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে গ্রামের মেয়েদের সচেতন করে, সংগঠিত করে৷ কলকাতার জার্মান কনসুলেটের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিমবঙ্গের চার জেলায় নারী পাচারের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করছে জবালা৷ আলিপুরদুয়ার সেই চার জেলার একটি৷ কাজ করতে গিয়ে জবালার যা অভিজ্ঞতা, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারলে তাদের মধ্যে থেকেই প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে৷ একটি মেয়ের আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে যেতে পারে আরও অনেকের মধ্যে৷ এবং মেয়েদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর ভূমিকা নেয় ফুটবল! কারণ, ফুটবল খুব চট করে একজন ভালো খেলোয়াড়কে পরিচিতি এনে দেয়৷ পাড়ায়, স্কুলে৷ ফলে সেই মেয়েটির স্কুলছুট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে কমে যায়৷ নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত ক্ষমতাও শনাক্ত করা যায় ফুটবল দলের মধ্যে৷
আলিপুরদুয়ারে কিশোরী-তরুণী মেয়েদের এরকমই দুটি ফুটবল দল গড়ে তুলেছে জবালা৷ নভেম্বর ২০১৬ থেকে এই দুটি দল নিয়মিত ফুটবল খেলছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে৷ জার্মানির বিদেশ মন্ত্রকের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উন্নয়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সম্প্রতি মেয়েদের এই দু'টি ফুটবল দলের সদস্যদের হাতে খেলার পোশাক, জুতো এবং বল তুলে দিলেন কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল ডঃ মিশায়েল ফাইনার৷ তারপর একটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয় দু'টি দল৷
কিন্তু ফুটবল ঠিক কীভাবে বদলে দিচ্ছে আলিপুরদুয়ারের মেয়েদের? এর শুরুটা হয়েছিল মুর্শিদাবাদে, ডয়চে ভেলেকে জানালেন জবালা সংস্থার পক্ষ থেকে বৈতালী গাঙ্গুলি৷ মুর্শিদাবাদও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী আরেকটি জেলা, যেখানে নারী পাচারের হার বেশি৷ সেখানে একটি নাচের স্কুলে বাগড়া দিয়েছিলেন স্থানীয় মৌলভীরা৷ হতাশ হয়েছিল সেই মেয়েরা, যারা ভালোবেসে নাচ শিখছিল৷ তখনই জবালা'র মাথায় আসে এই সামাজিক অনুশাসনের শেকলগুলো ভাঙার কথা৷ ফুটবল ছেলেদের খেলা, মেয়েরা পুতুল খেলবে— এমন লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনের প্রচলিত ধারণাকেও তাঁরা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন৷ এবং সেই কাজটা করতে গিয়ে আরও নানা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল জবালা’র কর্মীদের৷ যেমন একটি মেয়ে জানিয়েছিল, সে আগে দু–একবার ফুটবল খেলেছে৷ বাড়িতে যখন কেউ ছিল না, দরজা বন্ধ করে ভাইয়ের ফুটবলে লাথি কষিয়েছে৷ বৈতালী গাঙ্গুলি জানাচ্ছেন, এই মেয়েদের জন্যে ফুটবল খেলাটা এক ধরনের মানসিক চিকিৎসারও কাজ করেছে৷ ওদের বলা হতো, যে লোকটির কাছে কখনও নিগৃহিত হতে হয়েছে, অথবা যে লোকটি ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে পাচার করে দিতে চেয়েছিল, তাদের মুখ মনে করে ফুটবলে লাথি মারো!
যে কারণে ওরা এই ফুটবলের নাম দিয়েছেন ‘ফুটবল ফর ফ্রিডম’। স্বাধীনতার জন্য ফুটবল৷ যে খেলা প্রান্তিক এলাকার মেয়েদের জন্যে উন্মোচিত করে দিয়েছে এক স্বাধীন আকাশ৷
২০১৫ সালের এই ছবিঘরটি দেখুন...