ট্রলারডুবি যে সত্যগুলো উন্মোচন করল
২১ জানুয়ারি ২০১৯১৫ জানুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে মুন্সিগঞ্জের মেঘনা নদীতে একটি তেল বোঝাই কার্গোর সাথে ধাক্কা লেগে একটি ট্রলার ডুবে যায়৷ মাটি বোঝাই ওই ট্রলারটিতে ৩৪ জন শ্রমিক ছিলেন৷ তাঁদের মধ্যে ১৪ জন সাঁতরে তীরে উঠলেও বাকি ২০ জনের ১৮জনেরই এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ রবিবার দু'জনের লাশ করা হয়৷
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা নিখোঁজদের সন্ধান পেতে ৬ দিন ধরে উদ্ধার অভিযান চালিয়েছি৷ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে৷''
আইন না মানার কারণেই এই দুর্ঘটনা?
নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘‘আইন না মানার জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটে৷ এই ধরনের নৌযান রাতে চলাচলের কোনো নিয়ম নেই, তারপরও চলছে৷ এগুলোর নকশা অনুমোদিত নয়৷ অবৈধভাবে চলাচল করছে৷ সার্ভে সার্টিফিকেট নেই৷ তাঁরা যে মাটি কেটে আনছে, তা-ও অবৈধ৷ এরসঙ্গে জড়িত সবাই ক্রিমিনাল৷''
তিনি জানান, ‘‘এই জলযানগুলো একেবারেই অবৈধ৷ তাদের কোনো ধরনের অনুমোদন নেই অভ্যন্তরীন জলপথে চলার৷''
দুর্ঘটনা ঘটে, হিসেব রাখে কে
বাংলাদেশে এই ধরনের অননুমোদিত জলযান কতগুলো বা বছরে কতগুলো দুর্ঘটনায় পড়ে তার কোনো হিসেব নেই৷ জলযানের হিসেব থাকলেও ট্রলার বা বাল্ক হেডের মতো জলযানের দুর্ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান আলাদা করে নেই সরকারি দপ্তরে৷
তবে গত ১৪ বছর ধরে নৌ নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোঙর-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫৩৫টি বড় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ এতে ৬ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে৷ এসব দুর্ঘটনা তদন্তে ৮শ'৬৩টি কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ নোঙর-এর সভাপতি সুমন শামস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই যে তদন্ত কমিটি হয়, তারা কোনোটিরই ফলাফল আমরা প্রকাশ হতে দেখি না৷ আর তেমন কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয় না৷''
‘নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বলতে আসলে কিছু নেই'
সুমন শামস বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি, যাঁরা এই নৌযান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা কোনো-না-কোনো পর্যায়ে প্রভাবশালী৷ কেউ সরকারে থাকেন, কেউ মন্ত্রী-এমপি, আবার কেউ স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী৷ ফলে তদন্ত কমিটি হলেও তার ফল আলোর মুখ দেখে না আর দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে দেখা যায় না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘নৌপথে কখন কোন ধরনের নৌযান চলবে, তার একটা নিয়ম আছে৷ কিন্তু সেটা কেউ মানে না৷ আর এটা দেখার যাদের দায়িত্ব, তারাও দেখেন না৷ মুন্সিগঞ্জে যে মাটিবাহী ট্রলার ডুবলো, ওই ট্রলার রাতে চলার কথা নয়, বাল্কহেড রাতে চলাটল নিষিদ্ধ৷ আমাদের নৌ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বলতে আসলে কিছু নেই৷ আর নির্মাণ-ত্রুটি, নকশা-ত্রুটি তো আছেই৷ এগুলো দেখার জন্য নৌ-পরিবহণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন, নৌ- পরিবহন অধিদপ্তর আছে৷ কিন্তু তাদের কাজের সমন্বয় নেই৷''
নৌযানের ‘প্রকৃত' সংখ্যা কত?
নৌযানের নকশা অনুমোদন বা ফিটনেস দেখার দায়িত্ব নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের৷ তারা অভ্যন্তরীন ও সমুদ্রগামী দুটোই দেখেন৷ তাদের ওয়েব সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট নৌযানের সংখ্যা ৯,৭২৫টি৷ কিন্তু অধিদপ্তর জানায়, এর প্রকৃত সংখ্যা এখন ১৪ হাজারের মতো হবে৷ এই নৌযানগুলো নিবন্ধিত এবং নকশা অনুমোদনের পর তৈরি করা৷ কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদীতে চলাচল করে সাত লাখের মতো নৌযান৷ অনুমোদনের বাইরে এত নৌযান চলাচল করে কিভাবে?
নৌ-রিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইনেই আছে, ৩০ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত নৌযানের কোনো অনুমোদন লাগবে না৷ তাদের নকশাও অনুমোদন করাতে হবে না৷ তাদের আইন থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে৷ তাই আমাদের এখানে ১৪ হাজারের মতো নৌযান নিবন্ধিত হলেও বিশ্বব্যাংকের হিসেবে নৌযান আছে সাত লাখেরও বেশি৷ মুন্সিগঞ্জে যে নৌযানটি ডুবেছে, সেটা বালু উত্তোলন ও বহনকারী বাল্ক হেড৷ এই ধরনের নৌযানের কিন্তু অনুমোদন নিতে হয় না৷ তবে রাতে তাদের চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আছে৷ আমরা প্রায়ই এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সতর্কীকরণ বিজ্ঞাপনও দেই৷ কিন্তু তারা মানে না৷'’
রাতের আঁধারে দুর্ঘটনার কবলে অবৈধ ট্রলার
কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘‘নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে কুয়াশার মধ্য দিয়ে নদীতে চলাচল করার কারণেই এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনা৷ আর ৩৪ জন মানুষ পরিবহণের ক্যাপাসিটিও ওই নৌযানের নেই৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছি, যাদের অনুমোদন লাগে না সে ধরনের নৌযানের একটা তালিকা করার৷ তাদের একটা শুমারির আওতায় আনতে চাই৷ তারপর আইনের আওতায় কিভাবে আনা যায় তা নিয়ে কাজ করব৷''