মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকবে শুধু অবচেতনে?
১ ডিসেম্বর ২০১৭পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর৷ অর্জিত হয় নিজস্ব ভূখণ্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা৷ ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মীমাংসা খোঁজার গোড়াতেই ছিল তার বীজ৷ পাকিস্তান জন্ম নেয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিভাজন সামনে এসে পড়ে ভাষার প্রশ্নে৷ একদিকে ভাষার প্রশ্নে অধিকার সচেতন বাঙালির আবেগ, অন্যদিকে রাজনীতির মারপ্যাঁচ – আসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন৷ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েই বাঙালি শুরু করে নিজের অস্তিত্ব খোঁজার নিজস্ব সংগ্রাম৷ জাতীয় জীবনের অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে অর্জিত হয় বহুল কাঙ্খিত বিজয়৷
‘বাংলাদেশ’ শব্দটির সাথে যেমন জড়িয়ে আছে অসংখ্য মুক্তপ্রাণ মানুষের স্বপ্ন ও লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনি, তেমনি আছে এ দেশের কিছু মানুষের মানবতাবিরোধী ভূমিকা৷ স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে কলঙ্ক মোচনের পথে একধাপ এগোয় বাংলাদেশ৷ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত সামাল দিয়ে এ পর্যন্ত ২৯ জনের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হয়েছে৷ তারপরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের পথ মসৃণ হয়নি৷
প্রজন্ম একাত্তরের প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমানের মতে, এর প্রধান কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অনৈক্য৷ তিনি মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, শহিদের আত্মাহুতি নিয়ে ভেদাভেদ করে কখনো মুক্তিযু্দ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রাজাকারদের মধ্যে কিন্তু কোনো বিভেদ নেই, অথচ আমাদের মধ্যে বিভেদ আছে৷ এভাবে এখানে আমার ছিল, ওখানে আমার অবদান ছিল, এ সব বলে লাভ হবে না৷ অখণ্ড মুক্তিযু্দ্ধকে ফেরত আনতে হবে, যেখানে গুটিকয়েক রাজাকার বাদ দিলে বাকি সবাই মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিল৷’’
কেবল অখণ্ড মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নানা বিভক্তিই নয়, বিভক্তি তৈরি হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়েও৷ রাজনীতির খেলায় ধর্মনিরপেক্ষ দেশের স্বপ্নেও আঁচড় লেগেছে বারবার৷ রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যেন হাঁটতে শুরু করেছে একাত্তরের উল্টো পথে৷ পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনার চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি৷ অন্যদিকে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হামলা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর৷ অনেকেই মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থ৷ গবেষক আফসান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ গোটা ইতিহাস জুড়েই অসাম্প্রদায়িক৷ এখনকার যে সাম্প্রদায়িক চরিত্র, তার সাথে স্বার্থের বিষয় জড়িত৷ নাসির নগরের ঘটনা থেকে শুরু করে সব ঘটনার ক্ষেত্রেই তাই৷ এই যে হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ, এটা তো হয় দেবোত্তর সম্পত্তি দখল করার জন্য৷ স্বার্থের সংঘাত থেকেই এ সব শুরু হয়৷ তারপর সবার উপর সে দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়৷’’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের এ বিচ্যুতি সংশোধনে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলগতভাবে জামায়াত ইসলামির বিচার এখনো সম্ভব হয়নি, বরং ভোটের মাঠে দলটি গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে বিবেচিত হয়৷ আর তারই পথ ধরে দীর্ঘদিন দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এ দলটি৷ অন্যদিকে, মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কট্টর ইসলামি অনেক সংগঠনও৷ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে দাবি করা আওয়ামী লীগও ভোটের রাজনীতিতে হাত মিলিয়েছে উগ্রপন্থি ধর্মীয় গোষ্ঠির সাথে৷
তবে বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে বলে মনে করেন অনেকে৷ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি তারিক আলি বলেন, ‘‘জামায়াত ইসলামির বিষয়ে কথা বলার কিছু নেই, কারণ তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণাতেই বিশ্বাস করে না৷ বিএনপির ক্ষেত্রে তারা ইসলামের লেবাস পড়া একটি দেশ চায়, তাদের সম্পর্কেও তাই বলা কিছু নেই৷ তবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা আরো অসাম্প্রদায়িক ব্যবহার আশা করেছিলাম৷ কিন্তু আমি এটাও দেখছি যে সারা পৃথিবীতে যে হাওয়া বইছে, আওয়ামী লীগের কিছুটা ছাড় দিয়ে চলতে হবে যদি আগামীতে সরকার গঠন করতে চায়৷’’ তিনি বলেন, যদিও এ মুহূর্তে দেশে সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়েছে, তবে বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই বহুত্ববাদে বিশ্বাসী আর তাই এ দেশের মাটিতে কখনো কট্টর কোনো মতবাদ শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে না৷
তবে শহিদ সন্তান সাইদুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে নীতি-নির্ধারকরা যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি এত বছরেও৷ আর তাই রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ইতিহাসের অখণ্ড সত্যকে সামনে না আনা গেলে ‘মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটি শেষপর্যন্ত কেবল ‘কথার কথা’ হয়ে দাঁড়াবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...