রংপুরে হিন্দুদের উপর ‘পরিকল্পিতভাবে হামলা’
১১ নভেম্বর ২০১৭‘‘ক'দিন ধরে হামলার প্রস্তুতি চলছে৷ মাঝে মিছিল-সমাবেশও করেছে৷ শেষ পর্যন্ত শুক্রবার জুমার নামাজের পর লাঠিসোটা নিয়ে ৫ হাজারের বেশি মুসল্লি হামলা করে৷ ওরা কাউকে মারধোর করেনি সত্য, কিন্তু লুটপাটের পর বাড়ি-ঘর ভেঙে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে৷ আমাদের গ্রাম থেকে অন্তত ৫০টি গরু নিয়ে গেছে ওরা৷ এছাড়া ঘরে যা ছিল তার সবই লুট করেছে৷ এমনভাবে আগুন দিয়েছে মনে হবে সব পুড়ে গেছে৷ আসলে তা নয়,'' টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের দীপক কুমার রায়৷ তাঁর বাড়ি না পুড়লেও প্রতিবেশী স্কুল শিক্ষক দীপকসহ আরো অনেকেরই ঘর পুড়েছে৷
ফেসবুকে কথিত একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে শুক্রবার দুপুরে রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামে লুটপাট হয়েছে হিন্দুদের বাড়িতে৷ বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে গ্রামের ৩০টি হিন্দু বাড়ির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ শনিবার দুপুর পর্যন্ত পরিবারগুলো খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করছিলেন৷ স্থানীয়রা জানান, গরু-ছাগলসহ তাদের সব মালামাল লুট হয়েছে৷ লুটপাটের এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়৷ এতে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছে৷ এই ঘটনার পর থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে৷ ওই এলাকার শত শত হিন্দু পরিবার এখন আছে নিরাপত্তাহীনতায়৷ আবারও হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের৷
‘প্রশাসনের সামনেই হামলা'
দীপক কুমার রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রশাসনের সামনেই ওরা লাঠিসোটা নিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ল৷ তখনই যদি প্রশাসন বাধা দিতো তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না৷ আর কয়েকদিন ধরেই ওরা গ্রামে মহড়া দিচ্ছে৷ হামলা চালাতে পারে এমন আশঙ্কা শুধু আমাদের নয়, খোদ প্রশাসনেরও ছিল৷ তারপরও ঠেকানো গেল না এই হামলা৷''
তিনি বলেন, ‘‘শুক্রবার নামাজের সময় ওরা আশপাশের গ্রামে মাইকিং করেছে৷ বলেছে, ধর্ম অবমাননা হয়েছে, যেতে হবে৷ সবাই তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে এসেছে৷ আমাদের গ্রামের অনেক মানুষ তখন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল৷ এখনো সবাই গ্রামে ফিরতে পারেনি৷''
মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাটেনি৷ ঘরপোড়া শতাধিক মানুষ রাতভর জেগে ছিলেন৷ উৎকণ্ঠায় তাদের রাত কেটেছে৷ পুড়ে যাওয়া ঘরগুলো ধ্বংসস্তূপের মতো পড়ে আছে৷ গ্রামে সকাল পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা গেছে৷ শনিবার সকালে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে৷ তারা সাংবাদিকদের বলেছে, ‘‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতেই পরিকল্পিতভাবে এই হিন্দু পল্লিতে হামলা চালানো হয়েছে৷''
টিটু ‘স্ট্যাটাস দেয়নি', তবে ‘ক্ষোভ ছিল'
এদিকে, দীপক কুমার রায় বলছেন, ‘‘যাকে নিয়ে এই হামলা সেই টিটু রায় থাকেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়৷ চার বছর আগে কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে পালিয়ে গেছেন টিটু৷ টিটুর বাড়ি এই ঠাকুরপাড়া গ্রামে৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন৷ আসলে এই স্ট্যাটাস কেউ দেখেননি৷''
টিটু রায়ের ভাই বিপুল রায় বলেন, ‘‘আমার ভাই অশিক্ষিত৷ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কবিরাজি করে বেড়ায়৷ সে ফেসবুক তেমন চালাতে পারে না৷ টিটু ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেয়নি৷ কে বা কারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তার ফেসবুকে পরিকল্পিভাবে হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেয়৷'' টিটু রায়ের মা জিতেনবালা বলেন, ‘‘কেন আমাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া হলো আমরা জানি না৷''
রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি নিজে তার (টিটু রায়) ফেসবুকে গিয়ে দেখেছি, এই ধরনের কোন স্ট্যাটাস নেই৷ কিন্তু তারপরও ওরা স্ক্রিনশট নিয়ে কালার প্রিন্ট করেছে৷ সেটা দিয়েই মানুষকে উত্তেজিত করেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আসলে যে ছেলেটা মারা গেছে তার নাম হাবিবুর রহমান৷ সে জামায়াত শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত৷ যেভাবে হামলা হয়েছে তাতে আমাদের মনে হয়েছে এরা জামায়াত শিবিরের লোক৷ না হলে যেভাবে বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুটপাট এবং আগুন দেয়া হয়েছে সেটা সাধারণ মানুষের কাজ নয়৷''
তিনি বলেন, ‘‘টিটুর দুই বোন মুসলমান হয়ে গেছে৷ তারা মুসলমান পরিবারে বিয়ে করেছে৷ এ নিয়ে টিটুর ক্ষোভ ছিল, আর সেটা থাকতেই পারে৷ এখন আসলে পুরো ঘটনা আমরা তদন্ত শুরু করেছি৷''
গ্রেপ্তার জামায়াতের স্থানীয় আমি ও সেক্রেটারি
পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘‘হিন্দুপল্লিতে হামলার ঘটনায় শুক্রবার রাতে ৫৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে পীরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির এবং সেক্রেটারিও আছেন৷ এছাড়া গঙ্গাচরা ও কোতয়ালি থানায় দু'টি মামলা করা হয়েছে৷ এই মামলায় কিছু মানুষের নাম উল্লেখ করা হয়েছে৷ এছাড়া অজ্ঞাত রাখা হয়েছে বেশ কিছু মানুষকে৷ আমরা ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি৷ যারা এই ঘটনায় যুক্ত তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না৷''
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার খলেয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসানুজ্জামান হাসু শাহ্ অভিযোগ করেন, ‘‘গত মঙ্গলবার ওই ইউনিয়নের টিটু রায় নামে এক যুবকের ফেসবুকে হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কথিত কটূক্তির প্রতিবাদে এলাকাবাসী মানববন্ধন করে৷ এ ঘটনাকে পুঁজি করে জামায়াত ইসলামের নেতাকর্মীরা গত কয়েকদিন থেকে রংপুরের গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জ, নীলফামারী জেলার কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে প্রচার চালিয়ে দলীয় নেতাকর্মীসহ মুসল্লিদের উত্তেজিত করে তোলে৷''
তিনি বলেন, ‘‘শুক্রবারও জুমার নামাজের পর জামায়াত-শিবিরের কয়েক হাজার নেতাকর্মী সংঘবদ্ধ হয়ে পাগলাপীল এলাকায় পরিকল্পিতভাবে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে৷ পরে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে৷ এ সময় সেখানকার দু'টি মন্দিরে আগুন দেয় তারা এবং মন্দিরের মাইকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়৷ এর মধ্যে একটি মন্দির আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়৷ এ সময় হামলাকারীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫-২০টি বাড়ির গরু-ছাগল, হাস-মুরগি লুটপাট করে নেওয়াসহ তাদের ধান, গোলা ঘর, খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়৷''
আগুনে টিটু রায়ের ৩টি ঘর ছাড়াও সুধীর রায়ের ৬টি ঘর, অমূল্য রায়ের দু'টি ঘর, বিধান রায়ের দু'টি ঘর, কৌশল্য রায়ের দু'টি, কুলীন রায়ের একটি, দীনেশ রায়ের একটি, ক্ষীরোদ রায়ের একটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷
রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) আবু রাফা মো. আরিফকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল-এ) সাইফুর রহমান এবং সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান৷
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘‘এতো অল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক হয়ে সহিংস ঘটনা ঘটানোয় আমরা এটিকে পরিকল্পিত বলে মনে করছি৷'' কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷