মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নারী নেত্রী রাশেদা
২ নভেম্বর ২০১১১৯৫১ সালের পহেলা জুলাই কুমিল্লায় জন্ম সাহসী নারী রাশেদা রহমানের৷ বাবা কাজী সিরাজুল হক এবং মা আমেনা খাতুন৷ উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকতেই ১৯৬৫ সালে ছাত্র আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন রাশেদা৷ ছাত্রলীগের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ ঝোঁক৷ তাই কুমিল্লা মহিলা কলেজে ভর্তির পর থেকেই ছাত্রলীগের সামনের সারিতে চলে আসেন তিনি৷ ১৯৬৬ সালে কলেজে গঠিত ছাত্রলীগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে মনোনীত হন৷ ফলে ৬৯'এর ছাত্র আন্দোলন, ৭০'এর নির্বাচন এবং ৭১'এর স্বাধিকার আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন রাশেদা৷
১৯৭১ সালের শুরু থেকেই অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই স্বাধিকার ও নানা দাবি-দাওয়া আদায়ে কুমিল্লার নারীদের সুসংগঠিত করতে থাকেন, মিছিল-মিটিং চালাতে থাকেন রাশেদা এবং তাঁর সহকর্মীরা৷ মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভানেত্রী ছিলেন রাশেদা রহমান৷ এসময় এক ছাত্রনেতার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি৷ তাঁর স্বামী ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক এবং তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ ডাকসু'র সদস্য৷ তবে বিয়ের আনন্দ-উৎসবের বদলে আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য রাজপথেই কাটে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম পর্ব৷
১৭ মার্চ তৎকালীন আওয়ামী লীগের কুমিল্লা জেলা সভাপতির উপস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবক মহিলা লীগ গঠন করা হয়৷ আহ্বায়ক ছিলেন রাশেদা৷ ২৩ মার্চ কুমিল্লার টাউন হলে সর্বস্তরের মহিলাদের নিয়ে একটি সভা হয়৷ সভাপতিত্ব করেন তিনি৷ ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকবাহিনীর হামলা-নির্যাতন শুরু হয়৷ শহর থেকে গ্রামের দিকে ছোটে মানুষ৷ মার্চের শেষের দিকে গ্রামের বাড়ি চৌদ্দগ্রামে যান রাশেদা এবং তাঁর পরিবার৷ ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা স্বামী আগেই ভারত পাড়ি দেন৷ এপ্রিলে রাশেদাও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ত্রিপুরার রাধানগরে এক সরকারি চিকিৎসকের বাংলোয় আশ্রয় নেন৷ রাশেদা এবং তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী ঐ বাড়িতে থাকায় সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত হয়৷ বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে বিভিন্ন অভিযান চালানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে এসে হাজির হতেন৷ অস্ত্র জমা রাখতেন, বিশ্রাম করতেন এবং পরিকল্পনা মাফিক সশস্ত্র অভিযানে যেতেন তারা৷
ডয়চে ভেলের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেখানকার কিছু ঘটনা তুলে ধরেন রাশেদা রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বাসায় খাটের নীচে অনেক গ্রেনেড, গোলা বারুদ, রাইফেলসহ নানা অস্ত্র শস্ত্র লুকিয়ে রাখতাম৷ এখন সেসব দিনের কথা ভাবলে শিউরে উঠি৷ একদিন আগরতলা থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আসলেন৷ ফেনির কোন একটা জায়গায় অভিযানে যাবেন তারা৷ এ অঞ্চলটি ছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টর৷ তাদের মধ্যে ইপিআর-এর সুবেদার পদের একজন ছিলেন৷ তাঁর নাম মানিক৷ যুদ্ধে যাচ্ছে অথচ লুঙ্গি পরা এবং ভালো জামাও নেই৷ তাই মানিক ভাইকে আমার স্বামীর একটি নীল জামা দিলাম৷ তারা আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করল৷ বাড়ির সামনের মাঠে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের কলা-কৌশলের মহড়া দিল৷ এরপর সবাই অভিযানে রওয়ানা দিল৷ এর তিন চারদিন পর শুনলাম মানিক ভাই যুদ্ধে মারা গেছেন৷ তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন৷ কিন্তু জিপে করে প্রায় ১০০ মাইল দূরে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে মারা গেছেন৷ খবরটা যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলাম না৷''
এরপর রাধানগরে একটি টিলার উপর বন বিভাগের পরিত্যক্ত বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়েছেন রাশেদা এবং তাঁর স্বামী৷ সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতেন তাঁরা৷ কিছুদিন পর আগরতলা যান৷ মুক্তিযুদ্ধে যেতে আগ্রহী যুবকদের জন্য গঠিত যুব শিবিরে পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ পরে বিশ্রামগঞ্জে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় সহযোগিতার কাজে যোগ দেন রাশেদা৷ এছাড়া শরণার্থী শিশুদের জন্য গড়ে তোলা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তিনি৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মহিলা আওয়ামী লীগের সামনের সারিতে থেকে কাজ করেছেন৷ লায়ন্স ক্লাবের সাথে থেকে সমাজসেবার কাজ করছেন৷ এছাড়া দক্ষ ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে কুমিল্লা জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক পদে ২৭ বছর ধরে রয়েছেন তিনি৷ বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কেন্দ্রীয় পরিষদের তিনি নির্বাচিত সহ-সভাপতি৷ আবাহনী ক্রীড়া চক্র এবং বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের সাথেও রয়েছেন রাশেদা রহমান৷ জড়িত রয়েছেন মহিলা সমিতি এবং মানবাধিকার পরিষদসহ নানা সমাজ সেবামূলক সংগঠনের সাথে৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক