মেয়েদের পথে বাধা তো সেই জন্মানোর আগে থেকেই৷ মেয়ে হয়েছে কোনোভাবে জানতে পারলে, এখনো হিন্দি বলয়ের একটা বড় অংশে তাকে জীবনের আলোই দেখতে দেয়া হয় না৷ গর্ভপাত নামে অস্ত্রটা আছে না! সেসব এড়িয়ে যদিও বা মেয়ে জন্মালো তাহলে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়, সে অবাঞ্ছিত৷ সবেতেই পুরুষের আগে ভাগ৷ তারা পাওয়ার পর তো মেয়ের ভাগ৷ তা সে খেলা বা শিক্ষাই হোক অথবা মাছের পেটি৷ মেয়ে মানে যেন ঘরের কাজ করার জন্য জন্ম৷ খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার যাওয়াটাও তাদের কাছে বড় কথা৷ আজও, এখনো৷
সেই মেয়ে বড় হয়৷ ঘরে নিষেধাজ্ঞার বেড়ায় বন্দি অবস্থায় দিন কাটতে থাকে৷ তখন তারা একটুকরো মুক্তির জায়গা খোঁজে৷ যেমন খুঁজেছিল বর্ধমানের মেয়ে সোনিয়া খাতুন৷ সোনিয়ার কাছে একটুকরো ফুটবল মাঠ ছিল মুক্তির জায়গা৷ কিন্তু হাফপ্যান্ট পরে খেলতে হবে, বাড়ি ফিরতে দেরি হবে, বাইরে গিয়ে খেলতে হবে, এ সব নিয়ে পরিবারের ছিল মহা-আপত্তি৷ সোনিয়ার বাবা ঘাস কেটে মাসে হাজার চারেক টাকা রোজগার করেন৷ এই গরিব পরিবারের মেয়ে কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছিল একটি ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলতে৷ সেখানেই ডিডাব্লিউকে জানিয়েছিল তার এই কাহিনি৷
দক্ষিণ ২৪ পরগনার দীপিকা নস্করের কাহিনিও একইরকম৷ মেয়ে খেললে হাত-পা ভাঙতে পারে, তখন বিয়ে হবে না, তাই বাবা-মা ফুটবল খেলতে দিতে চাননি৷ জোর করে ফুটবল খেলেছেন দীপিকা৷ তার কাছেও ওই চামড়ার বল নিয়ে ড্রিবল করা, প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে গোল করার চেষ্টার মধ্যে আছে মুক্তির আনন্দ৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনার আরেক মেয়ে মল্লিকা সাঁপুই যেমন স্বপ্ন দেখেন ফুটবল খেলে অনেকদূর এগোবেন৷ নাম হবে৷ কাগজে ছবি বেরোবে৷ তাহলে বাড়ির বাধাও অতিক্রম করা যাবে৷
এদের স্বপ্নপূরণ হবে, নাকি বিয়ের বয়স হলেই সাতপাকে বাধা পড়তে হবে, তা জানি না৷ শুধু জানি, অতি গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়েরা ঠিকভাবে খেতে পান না৷ বাড়ির, পাড়া-পড়শির, রক্ষণশীল সমাজের বাধা তো আছেই, তার উপরে আছে পুরুষদের লোভী দৃষ্টি৷ অনেক কিছুর বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হয়৷ প্রতিপদে বাধা অতিক্রম করতে হয়৷
এরা কেউ ভারতীয় দলে খেলেনি, রাজ্য়ের দলেও নয়৷ কেউ কেউ জেলার দলে খেলেছে৷ বাবার মাসে আয় চার-পাঁচ হাজার টাকা৷ সেই জায়গা থেকে ফুটবল খেলে উঠে আসার জন্য বাধার এভারেস্ট পেরোতে হয় প্রতিদিন৷ তাও তারা লড়ছে৷ এই লড়াইটাই তাদের সম্বল, এই লড়াইটাই তাদের শক্তি, আর এই লড়াইটাই তাদের প্রেরণা৷
ভারতীয় নারী হকি টিমের দিকে তাকানো যাক৷ ২০২১-এর অলিম্পিকে যারা সেমিফাইনালে উঠেছিল৷ গ্রেট ব্রিটেনের কাছে সেমিফাইনালে তিন-চার গোলে হেরে যায়৷ শেষ পর্যন্ত ব্রোঞ্জ পায়৷
সেই দলের প্লেয়ার রানি রামপালের বাবা-মা তাকে বলেছিলেন, হকি খেলে কী হবে? ছোট স্কার্ট পরে খেলবে আর পরিবারের বদনাম হবে৷ বন্দনা কাটারিয়াকে বলা হয়েছিল, হকি মেয়েদের খেলাই নয়৷ পুরুষদের খেলা৷ নিশা ওয়ারসির মা একটা ফোম কারখানায় কাজ করেন৷ বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত৷ মেয়ের জন্য সামান্য খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন তিনি৷ ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী মেয়ে নিকি প্রধান খেতে কাজ করেন৷ ধার করে একটা ভাঙা হকিস্টিক দিয়ে খেলতেন৷ পাথর ভর্তি মাঠে খেলে নিজেকে তৈরি করেছেন৷
এখন ভারতীয় দলে খেলে সাফল্য পাওয়ার পর তাদের সুনাম হয়েছে, তারা সাফল্য পেয়েছেন৷ কিছুটা অর্থ হাতে এসেছে৷ কিন্তু তারা লড়াই ভোলেননি৷ তাদের প্রতিদিনের লড়াই৷ এখনো হকি স্টিক নিয়ে তারা যখন মাঠে নামেন, তখন চোয়াল শক্ত হয়৷ তারা নিজেদের তৈরি করেন আরেকটা লড়াইয়ের জন্য৷ তারা জানেন তাদের পথ ওই মাঠের মতো পাথর বিছানো থাকবে৷ কখনই মসৃন হবে না৷
কী মনে হচ্ছে? চাক দে ইন্ডিয়ার উপাদানও তো জীবন থেকে নেয়া৷ কমনওয়েলথ গেমসে মেয়েদের হকি টিমের সাফল্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়৷ কিন্তু এই ফুটবল বা হকি প্লেয়ারদের জীবন সিনেমার থেকেও অনেক অনেক বেশি খারাপ৷ আরো সংগ্রামের৷
একটা সময়, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম একটা স্লোগান দিত, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই৷’ শ্রমজীবীদের জন্য মধ্যবিত্তদের কিছুটা রোম্যান্টিক স্লোগান৷ লড়াই প্রত্যেকের জীবনেই থাকে৷ ইন্দ্রা নুয়ি বা কিরণ মজুমদার শ-রাও লড়াই করে শিল্পসাম্রাজ্যের প্রধান হয়েছেন৷ কিন্তু এই সাধারণ, প্রত্যন্ত এলাকায় থাকা, একেবারে নাম না জানা মেয়েদের প্রতিদিনের লড়াইয়ের কাছে সবকিছু ফিকে হয়ে য়ায়৷ দেখে মনে হয়, বাধা টপকানোর জন্যই যেন মেয়েদের জন্ম হয়েছে৷ ঘরে পুরুষ-কর্তা, সংস্থায় পুরুষ কর্মকর্তা, কোচ থেকে শুরু করে সর্বত্রই তো পুরুষ রাজ৷ সেই পুরুষরাও তো মান্ধাতার আমলের ধ্যান ধারণা নিয়ে মেয়েদের সামনে শুধু বাধার গণ্ডিই কাটতে পারেন৷
এত বাধা পেরিয়ে তারা যখন সফল হন, তখন তো তাদের নিয়ে আলোড়ন হবেই৷ তখন মানুষ হইহই করে তাদের সম্বর্ধনা দেন, তাদের দেখতে প্রচুর ভিড় হয়৷ হাততালি দেয়া হয়৷ দিন কয়েক সংবাদমাধ্যমের পাতায় প্রশংসার ঝড় বয়ে য়ায়৷ কিন্তু তারপর? তাদের সামনে কি বাধার পাহাড় সরে যায়৷ নাহ, যায় না৷ তারা আবার পরিবারের, আশপাশের সব মানুষের বাধার মুখে পড়েন৷ আবার তাদের আপ্রাণ লড়াই করতে হয়৷ যারা সফল হন, তারা অল্পদিন হাততালি পান, যারা সাফল্য পান না, তারা অকালে ঝরে যান৷ মাঠ নয়, অন্য কোনো মুক্তির জায়গা নয়, তাদের ঠাঁই হয় সেই হেঁসেলে৷
একটা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে শেষ করি, ৫২ শতাংশের বেশি ভারতীয় মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় সাড়ে আঠারো বছর বয়সের মধ্যেই৷ আর ২৭ থেকে ৩২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৭ বছর বা তার কম বয়সে৷ বাবার বাড়িতে থেকেই এত বাধার পাহাড় ঠেলতে হয় শুধু খেলার জন্য, পড়ার জন্য, সেখানে শ্বশুরবাড়িতে গেলে কী হবে তা রকেট সায়েন্সের মতো কঠিন কোনো বিষয় নয়৷ সহজেই বোঝা যায়৷