মমতার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংঘাত বাড়ছে
১৮ মার্চ ২০২১একুশেরনির্বাচনের নির্ঘণ্টঘোষণার পরেই রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে নির্বাচন কমিশনের হাতে৷ একদিকে কমিশনের লক্ষ্য একশ শতাংশ হিংসামুক্ত নির্বাচন৷ অন্যদিকে, কমিশনের নিরপেক্ষতাই পড়ছে প্রশ্নের মুখে৷ শাসক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংঘাতের পারদ চড়ছে৷
নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ
রাজ্যে আদর্শ আচরণ বিধি চালু হয়ে গিয়েছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার বঙ্গ সফরে এসে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন৷ একইরকমভাবে বাঁকুড়ার সভা থেকে মমতা ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তাতেই নির্বাচন কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ দায়ের করেছে৷ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মমতা এখনও মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন৷ সরকারি প্রকল্প নিয়ে নির্বাচনী সভায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া কার্যত নির্বাচনী বিধিভঙ্গের সামিল৷ কিন্তু বিজেপির নেতৃত্বের কেউই রাজ্যের শাসক দলের অংশ নন৷ তাই আচরণবিধি তাদের ক্ষেত্রে খাটে না৷
পক্ষপাতের অভিযোগ
নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগের পাল্টা হিসেবে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা৷ তার অভিযোগ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচন কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করছেন৷ কেন্দ্রের কথায় কমিশন পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ এভাবে চলতে থাকলে আহত পা নিয়ে তিনি কমিশনে ধর্নায় বসবেন৷ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা পাল্টা বলেছেন, ‘‘মমতা ভয় পেয়ে গিয়েছেন৷ হার নিশ্চিত বুঝে এই অভিযোগ তুলছেন৷'' কমিশনকে জড়িয়ে এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনে কতটা ক্ষতি গণতন্ত্রের? পর্যবেক্ষক, অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল বলেন, ‘‘কমিশনের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘাত কোনো নতুন বিষয় নয়৷ ১৯৯১ সালে বাম সরকারের সঙ্গে কমিশনের সংঘাত হয়েছিল৷ কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে যদি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে গণতন্ত্রের পক্ষে তা ক্ষতিকারক৷''
কেন মমতার ক্ষোভ?
১) কমিশনের বিরুদ্ধে মমতার ক্ষোভের সূচনা ভোট ঘোষণার দিন থেকে৷ নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গ আট দফা ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ অথচ ২৩৯ আসনের তামিলনাড়ু বিধানসভার ভোট নেওয়া হবে এক দিনে৷ মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, কেন পশ্চিমবঙ্গে এত দফায় ভোট নেওয়া হবে?
২) কমিশন এবার রাজ্যে প্রায় ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এতেও আপত্তি জানিয়েছে তৃণমূল৷ বাকি সব রাজ্যে একজন করে বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক থাকছেন৷ অথচ নজিরবিহীন হলেও এবার বাংলায় থাকছে দুজন বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষক - মৃণালকান্তি দাস ও বিবেক দুবে৷ এই দুবেকে নিয়ে আপত্তি রয়েছে তৃণমূলের৷
৩) পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়েছে রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্রর অপসারণে৷ পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে সরিয়েছে কমিশন, যারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকদের একাংশ৷
৪)নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত হওয়ার পর তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছে, কেন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দিতে পারল না? চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ অথচ কমিশনের রিপোর্ট, নন্দীগ্রামে নিছক দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ কোনো চক্রান্ত নেই৷
৫) কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ২৭ মার্চ প্রথম দফার নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে৷ ১০০ মিটারের বাইরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে৷ বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্য পুলিশকে বুথের কাছে ঘেঁষতে না দিলে তৃণমূল রিগিং করতে পারবে না৷ তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপির অঙ্গুলিহেলনে এই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন৷
বাড়ছে তিক্ততা
তৃণমূলের সঙ্গে কমিশনের তিক্ততা ক্রমশ বাড়ছে৷ মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, তিনি হস্তক্ষেপ করছেন৷ আবার উপ নির্বাচন কমিশনার সুদীপ জৈন রাজ্য সরকারকে কড়া চিঠি লিখেছেন৷ তাঁর দাবি, কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য দুর্ভাগ্যজনক৷ এই সুদীপ জৈনকে রাজ্যে ভোটের দায়িত্ব থেকে সরানোর দাবিতে ইতিমধ্যে তৃণমূল দরবার করেছে৷
সবমিলিয়ে সংঘাতের ছবি উঠে এলেও এর মধ্যে বাড়াবাড়ি দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কমিশন আট দফায়, দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন করাবে৷ এর ফলে কিছু জটিলতা তৈরি হতেই পারে৷ বিশেষত পুলিশ-প্রশাসনকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে৷ সেটাকে বড় ধরনের সংঘাত বলে ভাবা ঠিক নয়৷''