মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের ‘রুখতে' প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ
২০ এপ্রিল ২০২৪আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালকের বিরুদ্ধে গুরুতর এক অভিযোগ ওঠার পর এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো৷ উপজেলা নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে দলের মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রার্থী হতে নিষেধ করেছেন শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "নির্বাচন যাতে প্রভাবমুক্তভাবে হয়, সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আমরা আশা করছি, সবাই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতেই তিনি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। মন্ত্রী ও এমপিরা নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকার মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। আমি নিজে ওই প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। ঘটনার সময় তিনি দেশে ছিলেন না। তবে এই ঘটনার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং আহত ব্যক্তিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে তার শ্যালক নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। এমন আরও দু-একজন আছেন, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হচ্ছে।”
দেশে এখন ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। এবার চার ধাপে নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫টিতে ভোট হবে, পরে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাকিগুলোয় ভোটের আয়োজন করবে নির্বাচন কমিশন। আগামী ৮ মে থেকে প্রথম পর্যায়ের ভোট শুরু হবে।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের হস্তক্ষেপ এবং দলীয় বিভেদের তথ্য দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এরপর তিনি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ডেকে উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারে এই নির্দেশনা দেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের জানিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ওবায়দুল কাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকদের জানিয়ে দেন।
জানা গেছে, সাবেক নৌ-পরিবহণ মন্ত্রী শাজাহান খানের ছেলে মাদারীপুরে, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের শ্যালক নাটোরে, প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের ভাগ্নে টাঙ্গাইলে, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়নের ভাই নরসিংদীতে, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে নারায়নগঞ্জে, একরামুল করিম চৌধুরী এমপির ছেলে নোয়াখালীতে নির্বাচন করছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে ফোন করে স্বজনদের সরে যেতে বলতে বলা হয়েছে। এরপরও কেউ নির্বাচন থেকে সরে না এলে নির্দেশনা অমান্যকারীদের বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে।
নাটোরের সিংড়া উপজেলায় এক প্রার্থীকে তুলে নিয়ে মারধরের অভিযোগ উঠেছে প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই লুৎফুল হাবীব ওই এলাকার সংসদ সদস্য এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে নিজের ছেলে আতাহার ইশরাক সাবার চৌধুরীকে ভোট না দিলে উন্নয়ন কাজ না করার হুমকি দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। দলের সিদ্ধান্তের পর এখন ছেলে নির্বাচন করবে কিনা জানতে চাইলে একরামুল করিম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সাংগঠনিক সম্পাদক ফোন করে আমাকে দলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, আমার ছেলে যদি ভোট করতে না পারে তাহলে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যিনি আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আলম চৌধুরী সেলিমকেও সরে যেতে হবে। কারণ, কিছুদিন আগে তিনি নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন। তিনি সরে না গেলে আমার ছেলে সরে যাবে কিনা সেটা এখনও বলা যাবে না। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমাদের নোয়াখালীর অভিভাবক, তিনি যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা সেটা মেনে নেবো।”
নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করার বিষয়ে জানতে চাইলে খায়রুল আলম চৌধুরী সেলিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি কখনোই নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করিনি। উনি এখন মিথ্যা কথা বলছেন। আমি সুবর্ণচর উপজেলার টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। জাতীয় নির্বাচনে ভোটের সময় আমার কী ভূমিকা ছিল সেটা ওবায়দুল কাদের জানেন। ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে যদি আতাহার ইশরাক সাবার চৌধুরী সরে যান তো ভালো। না হলে দলই সিদ্ধান্ত নেবে।”
ওবায়দুল কাদের দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দপ্তরকে সারা দেশে নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজন ও পরিবারের সদস্য নির্বাচন করছেন, সেই তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। কথিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, "আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের যেন বলে দেয়, উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশ না নেওয়ার জন্য। এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ।”
উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী এমপি মন্ত্রীদের আত্মীয়-স্বজন প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন। এর ফলে নির্বাচনের পরিবেশে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। উপজেলা নির্বাচনে কাউকে সমর্থন না দিতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড বারবার নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু কেউ কেউ তা শুনেননি। এ কারণেই কঠোর নির্দেশনা এলো।
তবে সব এলাকায় পরিস্থিতি একই রকম নয়। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার এলাকার এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু। তিনি সাবেক মন্ত্রী। অথচ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তিনি কোনো প্রভাব বিস্তার করছেন না। এখন পর্যন্ত আমার উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৪-৫ জন প্রার্থী হয়েছেন। এলাকার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো। আমরা আশা করছি, এখানে ভালো নির্বাচন হবে।”
আইনে দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ভোট করার সুযোগ থাকলেও স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বা মনোনয়ন না দেওয়ার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ফলে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্বাচন করতে হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, "দলের কেন্দ্রীয় অধিকাংশ নেতার অভিমত ছিল দলীয় প্রতীক বরাদ্দের কারণে দলের তৃণমূলে গ্রুপিং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ না দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন দলের হাইকমান্ড।”