ভয়াবহ বন্যার কবলে সিলেটবাসী
২০ মে ২০২২এর আগে ২০০৪ সালে তাদের এলাকায় এমন বন্যা হয়েছিল বলে জানান সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রমজান আলী৷ এবার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, সেই শঙ্কায় আছেন তিনি৷ আশ্রয় কেন্দ্রেও বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকটের কথা বলছেন আশ্রয়গ্রহণকারীরা৷ পানিবন্দি মানুষগুলো ‘চোখে অন্ধকার' দেখছেন বলে ভাষ্য রমজান আলীর৷
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে৷ ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷
সিলেটের বন্যকবলিত এলাকার বাসিন্দারা দুর্বিসহ দিন পার করছেন৷ সেসব কথাই জানাতে গিয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পুর্ব রংপুর বস্তির বাসিন্দা রাশিদা বেগম বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে৷ চার সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভাসুরের ঘরে৷ কিন্তু চার দিকে পানিঘেরা কাঁচা ঘর কখন ভেঙে যায়, এ শঙ্কায় তার ঘুম নেই৷ রাশিদা বলেন, ‘‘ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না৷ ঘরে সাপ চলে আসে৷ ঘরে খাবারও নেই৷ চার সন্তান নিয়ে বিপদে পড়ে গেছি৷’’
কোম্পানীগঞ্জের কাঁঠালবাড়ি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় থানাবাজার আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন বৃদ্ধা রুমিনা আক্তার৷ হঠাৎ আসা ঢলে সব তলিয়ে যাওয়ায় অনেকটা শূন্য হাতে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও সেখানেও স্বস্তিতে নেই তিনি৷ এক প্যাকেট চিড়া ও গুড় সাহায্য পেয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বন্যায় সব কেড়ে নিয়েছে৷ এখন আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও পেটের ক্ষিধা মিটছে না৷ সরকারি ত্রাণ সহায়তা অত পাচ্ছি না৷ গরীবের কোনো উপায় নেই৷ এখন সামনের দিনগুলোতে কীভাবে খেয়ে বাঁচব তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে৷’’
হঠাৎ আসা পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো বেশি বন্যা কবলিত হয়েছে৷ সীমান্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাটের বাসিন্দারা দুর্বিষহ দিন পার করছেন৷ সড়কে বন্যার পানি থাকায় মানুষের যাতায়াত বন্ধ৷
মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর স্কুল বন্ধ ছিল৷ এখন হঠাৎ বন্যার কারণে আবারও স্কুল বন্ধ জানান কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের আব্দুল করিম৷
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের সহকারী প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ৩৪টি বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে বিভিন্ন এলাকায়৷ তাতে সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে৷
‘‘পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেক্সে৷ এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রেও পানি ওঠায় আশ্রিতরা বিপাকে পড়েছেন,’’ বলেন নিলয়৷
শুক্রবার সকাল ৯টায় সুমরা নদীর পানি কানাইঘাটে বিপৎসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার, সিলেটে ৩৮ সেন্টিমিটার এবং সুনামগঞ্জে ষোল সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল৷ তবে গত এক দিনে ওই তিন পয়েন্টেই সুরমা নদীর পানি কমতে শুরু করেছে৷
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে৷ আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জ জেলার নদীর পানির সমতল কিছু স্থানে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে৷
এই সময়ে সিলেট জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে, তবে সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হতে পারে৷
বন্যাকবলিত মানুষের বড় সংকট খাবার পানি৷ টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার উপায় নেই৷
জৈন্তাপুর উপজেলার ঘাটের ছটি গ্রামের আবুল হোসেন বলেন, ‘‘টিউবওয়েলও পানির নিচে৷ বিদ্যুৎ নাই৷ খাবার পানিও নেই৷ বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে হাওরের পানিই খাচ্ছি, জীবনতো বাঁচাতে হবে৷’’
উপজেলাগুলোর মত সিলেট মহানগরেও খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে বন্যা৷ বিদুৎ না থাকায় পানির সংকটে পড়েছেন নগরবাসী৷ নিচু এলাকায় ঘরের ভেতর হাঁটু পানির কারণে রান্না বন্ধ৷
গত তিন ধরে তার বাসায় বন্যার পানি৷ জরুরি কাগজপত্রসহ বিভিন্ন জিনিস নষ্ট হয়েছে জানান নগরীর তালতলা এলাকার বাসিন্দা আফজাল করিম৷
তিনি বলেন, ‘‘বাসায় পানি ওঠায় পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়র বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ পাহারা দেওয়ার জন্য কাছের একটা আবাসিক হোটেলে উঠেছি আমি৷’’
এদিকে নগরীতে বন্যার পানি দুর্গন্ধ ছড়ানোয় ভোগান্তিতর কথা জানিয়েছেন উপশহর এলাকার রহমান মিয়া৷
তিনি বলেন, ‘‘ঘরে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি৷ এর উপর বিদুৎ নেই তিন দিন ধরে৷ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷’’
নগরীর শেখঘাট বস্তির বাসিন্দা অনামিকা দাশ বলেন, ‘‘পুরো ঘরে জল৷ রান্না করতে পারছি না, খাবার পানিও নেই৷ আমার এক আত্মীয় কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছিলেন, সেটাই কাল খেয়েছি৷ আজ রাতে কী করব জানি না৷’’
অনামিকার মতো একই অবস্থা বন্যাকবলিত নগরীর বিভিন্ন এলাকার বস্তির মানুষদের৷ নগরীর যতরপুর এলাকার বাসিন্দা আজমল হোসেন জানান, বাসার সামনে পানির স্রোত বইছে৷ বাসা দোতলায় হওয়াতে রক্ষা পেয়েছেন৷ তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে, এত দ্রুত পানি বাড়তে আগে কখনও দেখেননি তিনি৷
সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহসান জানান, জেলার ১৩টি উপজেলার ৮৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে৷ ৩২৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ বর্তমানে ৯৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭ হাজার ৩৪৯ জন আশ্রয় গ্রহণ করেছেন৷
আশ্রিতদের শুকনো খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেট মহানগর ও উপজেলাগুলোতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ১৩ লাখ টাকা, ২৩৪ মেট্টিকটন চাল, ৩ হাজার ৯৯ প্যাকেট শুকনো খাবার সরবরাহ করা হয়েছে৷
এনএস/জেডএইচ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)