ভয় দেখাতে জিল্লুরের বাড়িতে পুলিশ, নাকি তুচ্ছ বিষয়ে অতিরঞ্জন?
২৩ ডিসেম্বর ২০২২তবে পুলিশের ভাষ্য, সাধারণ পুলিশিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহের জন্য পুলিশ সদস্যরা শরীয়তপুরের ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন৷
চ্যানেল আই-এর টক শো তৃতীয় মাত্রার জনপ্রিয় সঞ্চালক জিল্লুর রহমান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) নামে একটি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক৷ সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের নিয়ে মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর অনুষ্ঠান করছেন তিনি৷ এই অনুষ্ঠানে আসা জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে বেশ আলোচনা হয়৷ অনেকের মতো সরকার কিছুটা বেকায়দায়ও পড়ে৷ সম্প্রতি বিদেশি অতিথি এনে ঢাকায় ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন-২০২২’ নামে একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানও করেছেন তিনি৷
‘‘যে কারও বাড়িতেই তো পুলিশ তথ্য সংগ্রহের জন্য যেতে পারে, আপনার কেন মনে হচ্ছে, ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ আপনার গ্রামের বাড়িতে গেছে?’’ এ প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত জিল্লুর রহমান টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগে-পরে অনেকগুলো ঘটনা আছে৷ আমার জন্ম হয়েছে ঢাকায়৷ ঢাকাতেই থাকি৷ বছরে দুইবার গ্রামের বাড়িতে যাই চ্যারিটেবল কাজের জন্য৷ ঢাকায় আমার অফিসও আছে৷ পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করতে চাইলে আমার অফিসেও আসতে পারে৷ টেলিফোনেও আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে৷ তা না করে সিভিলে ও পোশাক পরা অবস্থায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যের আমার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া আমি স্বাভাবিক বলে মনে করতে পারি না৷ আমরা জানি তথ্য সংগ্রহে গেলে সিভিলে যায়৷ একজন যেতে পারেন৷ কয়েকজনের তো একসঙ্গে মহড়া দিতে যাওয়ার দরকার নেই৷’’
জিল্লুর রহমান মনে করেন, ‘‘তাকে ও তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের ভয় দেখানোর জন্য এটা করা হয়েছে৷’’ জিল্লুর রহমানের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার জুসিরগাঁও গ্রামে৷ বৃহস্পতিবারই ফেসবুকে একটা পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘এটা শুধু নিন্দনীয় নয়, এটা দেখা অত্যন্ত বিরক্তিকর যে, আমার কণ্ঠরোধ করতে পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে৷’’ এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি৷
তবে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট থানার ওসি আসলাম সিকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা খুবই ছোট্ট একটা ঘটনা৷ আমাদের এখানে বিট পুলিশিং চলছে৷ সে কারণে বিট পুলিশের সদস্যরা প্রত্যেক ইউনিয়নে খোঁজ নিচ্ছেন ওই এলাকায় কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাড়ি৷ অধ্যাপক, চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা আছেন তাদের তথ্য নিচ্ছি আমরা৷ শুধু তাই নয়, চোর বা ডাকাতদের তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে৷ ওই এলাকায় কতগুলো স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা আছে সেটাও সংগ্রহ করছি৷ এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমার একজন পুলিশ সদস্য ওনার বাড়িতে গিয়েছিলেন৷ তা-ও বাড়ির ভেতরে না, বাইরে৷ ওনার একজন চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে পুলিশ সদস্যের কথা হয়েছে৷ উনি কোথায় থাকেন, কতদিন পরপর আসেন এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছে৷ পরে ওই পুলিশ সদস্যকে চা খেতে বাড়ির ভেতরে যাওয়ারও অনুরোধ করেছিলেন উনার চাচাতো ভাই৷ কিন্তু পুলিশ সদস্য যাননি৷ এটা একেবারেই একটা স্বাভাবিক ঘটনা, অযথা বিষয়টি নিয়ে টেনে হিঁচড়ে লম্বা করা হচ্ছে৷ এটা তেমন কিছুই না৷’’
কারো তথ্য সংগ্রহে পুলিশ কীভাবে কাজ করে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সিভিলে কেউ একজন গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে৷ সেটা তার বাড়িতে না গিয়ে প্রতিবেশী বা মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছ থেকেও তথ্য নিতে পারে৷ কিন্তু পোশাক পরে দলবল বেঁধে কখনো কারো ব্যাপারে তথ্য আনতে পুলিশ যেতে পারে না৷ অতি উৎসাহী কেউ এমনটা করে থাকতে পারে৷ আর পুলিশ কাউকে ভয় দেখাবে কেন? পুলিশ তো চাইলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে৷ সেখানে কাউকে ভয় দেখানোর জন্য যাওয়ার সুযোগ নেই৷’’
জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ‘‘থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান সিজিএসের যে কাজগুলো আমরা করছি সেটা নিয়ে সরকারের একটি মহল ভুল ব্যাখ্যা করছে৷ আমি এই প্রোগ্রামটাতে জিও পলিটিক্স নিয়ে কথা বলি৷ পাশাপাশি রিজিওনাল পলিটিক্স, সহযোগিতা এসব নিয়ে আলোচনা করি৷ এখানে অডিয়েন্স যারা থাকেন তারাও কিছু প্রশ্ন করেন৷ তারা অনেক সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন৷ সেটাও আমার দুই ঘন্টার অনুষ্ঠানের ৫-১০ মিনিটের বেশি না৷ আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলি না৷ সম্প্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতের একটা বক্তব্য নিয়ে মিডিয়া হাইপ তৈরি হয়েছে৷ এটা নিয়ে সরকারের দিক থেকে কেউ কেউ অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন৷ ওই অনুষ্ঠানের পর আমরা ঢাকায় ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন-২০২২’ নামে একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান করি৷ সেখানে সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর আসার কথা ছিল৷ পরে তারা আসেননি৷ এমনকি তৃতীয় দিনে একজন মন্ত্রী অনুষ্ঠানে এলেও আরেকজন মন্ত্রীর ফোনে তিনি বক্তব্য না দিয়েই চলে যান৷ এই অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথি ছাড়াও দেশীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন৷ আমাদের এই অনুষ্ঠানে খবর দু-একটি মিডিয়া ছাড়া অধিকাংশ মিডিয়াতে প্রচার হয়নি৷ পরে জেনেছি, টিভি ও পত্রিকাগুলোকে এই খবর প্রচার না করতে বলা হয়েছে৷ বিভিন্ন এজেন্সি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে৷ আমি নিশ্চিত তারা এখানে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কিছু পায়নি৷ এসব কারণে হয়ত সরকারের একটি মহল বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করে এসব কাজ করে থাকতে পারে৷’’
বে অব বেঙ্গল কনভারসেশনে অংশ নিয়েছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই অনুষ্ঠানে চমৎকার সব আলোচনা হয়েছে৷ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যেতে হলে এই অঞ্চলের অন্যান্য শক্তি ছোট বড় যারা আছে সেই দেশগুলোর সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন৷ আমি সেখানে আলোচনা করেছি, এই অঞ্চলের বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেটা আছে এসডিজি, সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য এই দেশগুলোর সহযোগিতা কেন গুরুত্বপূর্ণ৷ আমি এর মধ্যে অসুবিধার কোনো কিছু তো দেখিই না, মিডিয়ার উপস্থিতিতে আলোচনা হয়েছে৷ এতে গর্হিত কোনো কিছু আমি অন্তত লক্ষ্য করিনি৷’’
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পাকিস্তানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল আবদুর রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন জিল্লুর রহমান৷ সেই সাক্ষাৎকার চ্যানেল আই-এ প্রচার করা হয়েছিল৷ সরকারি দলের অনেকেই বিষয়টির এখনও সমালোচনা করেন৷ এছাড়া করোনা মহামারির সময় রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা করা রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদকে তৃতীয় মাত্রার ২১টি টকশোতে অতিথি হিসেবে আনারও সমালোচনা করেন অনেকে৷