গর্ভপাত করানোর অনুমতি দিল আদালত
৫ জুলাই ২০১৭মায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে অবশেষে এক অভুতপূর্ব অনুমতি দিল সুপ্রিম কোর্ট৷ ভ্রূণের অস্বাভাবিকতার মাত্রা বিবেচনা করে ২৬ সপ্তাহ পরেও গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হলো আবেদনকারী মাকে৷ ‘সন্তান প্রসব করা বা না করা নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার’ - এই মন্তব্য করে আবেদনের ভিত্তিতে এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে গর্ভপাতের অনুমতি দিয়েছে আদালত৷ বিচারপতি দীপক মিশ্র ও বিচারপতি এম খানউইলকরের বেঞ্চ বলেছে, ‘‘সব মহিলারই তাঁর নিজের শরীরের উপর অধিকার রয়েছে৷ শিশু বাঁচবে না জেনেও সেই ভ্রূণকে গর্ভে ধরে রাখা অতীব যন্ত্রণাদায়ক৷’’
পশ্চিমবঙ্গের বারাসতের এক অন্তঃসত্ত্বার ভ্রুণের বয়স যখন ২৩ সপ্তাহ, তখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন তিনি৷ কারণ তাঁর মেডিক্যাল রিপোর্ট বলেছিল, গর্ভস্থ সন্তান মোটেই স্বাভাবিক নয়৷ চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, ভ্রূণের হৃৎপিণ্ডে রয়েছে বড়সড় সমস্যা৷ শিশুর জন্মের পর তিন মাসের মধ্যে একাধিক বার ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’ করাতে হবে, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ এবং কষ্টদায়ক৷ তাছাড়া তারপরও শিশুটি বাঁচবে কিনা, সেটা বলা মুসকিল৷ সেই কারণেই গর্ভপাতের আর্জি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সেই মা৷
ভারতের বর্তমান আইন অনুযায়ী, এ দেশে ভ্রূণের বয়স ২০ সপ্তাহ হয়ে গেলে আর গর্ভপাত করানো যায় না৷ ভ্রূণের বয়স ২০ সপ্তাহের বেশি হয়ে গেলে গর্ভপাত বেআইনি হিসেবে গণ্য হয়৷ কেন্দ্রীয় সরকার এই সময়সীমা বাড়ানোর জন্য ভাবনাচিন্তা শুরু করলেও, তা বেশিদূর এগোয়নি৷ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ২০ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গর্ভপাতের অনুমতি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ সেক্ষেত্রে মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে অনুমতি দেয় শীর্ষ আদালত৷ জরুরি ভিত্তিতে কোনও মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি করে চিকিৎসকদের পরামর্শের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
সুপ্রিম কোর্টে বারাসতের দম্পতির আইনজীবী স্নেহা মুখার্জি ডয়েচে ভেলকে জানালেন, ‘‘১৯৭১ সালে যখন গর্ভপাত আইন তৈরি হয়েছিল, তখন হয়ত ২০ সপ্তাহের সময়সীমা ঠিক ছিল৷ কারণ নির্দিষ্ট সময়ের পরে গর্ভপাত হলে মায়ের প্রাণের ঝুঁকি থাকে৷ কিন্তু এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে ২৬ সপ্তাহ বা তার পরেও গর্ভপাত সম্পূর্ণ সুরক্ষিত৷’’ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর কলকাতার এসএসকেএম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের তত্ত্বাবধানেই গর্ভপাত করানো হবে বলে তিনি জানিয়েছেন৷
আদালতে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পক্ষে স্নেহা সওয়ালে বলেছেন, ইকো-কার্ডিওগ্রাফি করার পর জানা যায় ভ্রূণটি ‘টেট্রালজি অফ ফ্যালট’-এ ভুগছে৷ এটা এমন একটা হৃদরোগ, যা জন্মের সময়ই বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায়৷ এই রোগের ফলে জন্মানোর সময় বাচ্চার গায়ের রং হয় নীল৷ কিন্তু এই কথা যখন বাচ্চার বাবা-মা জানতে পেরেছেন, ততদিনে ভ্রূণের বয়স ২০ সপ্তাহ অতিক্রম করে গেছে৷ তারপর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগছেন ওই দম্পতি৷ সে কারণেই গর্ভপাতের আর্জি৷
বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউলের বেঞ্চ ওই দম্পতির আর্জি শুনে গত ২৩ জুন একটি চিকিৎসক দল গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে মত জানতে চেয়েছিলেন তাঁরা৷ সেইমতো এসএসকেএম-এর সাতজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল৷ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরাও আবেদনকারী মহিলার আর্জিতে সম্মতি জানিয়েছেন৷ অবশেষে দম্পতির আর্জিতে সম্মতি জানায় কোর্ট৷
স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ অমিয়ভূষণ সরকার জানাচ্ছেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে বহু দম্পতি এই সমস্যায় পড়েন৷ কিন্তু এক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছে তেমন সবসময় হয় না৷ কারণ সুপ্রিম কোর্ট তো অনেক দূর, নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার মতো সামর্থ্যও বহু মানুষের থাকে না৷ চিকিৎসকরাও আইনের প্যাঁচে পড়ে কিছুই করতে পারেন না৷ এখন যদি কেন্দ্র সরকার অথবা সুপ্রিম কোর্ট ১৯৭১ সালের গর্ভপাত আইনটি সংশোধন করে ২৬ সপ্তাহ বা ২৮ সপ্তাহ করে, তাহলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলতে পারে৷’’
এদিকে বারাসতে আবেদনকারিণীর স্বামীর কথায়, ‘‘কত রাত আমরা কেউ ঘুমোইনি৷ বারবার ভেবেছি, কী রায় হবে, জিতব তো? আবার ভেবেছি, হায় এ কীসের জয়! এ তো আমাদের প্রথম সন্তান!’’
মহিলার শ্বশুরমশায় নিজে বারাসতের স্বনামধন্য চিকিৎসক৷ তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘একই সঙ্গে খুশি এবং গভীর দুঃখের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ ওই শিশু ভূমিষ্ঠ হলে সে কতটা কষ্ট পেত, তার শরীরে কী কী সমস্যা ছিল তার সব রিপোর্টই আদালতের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল৷ নিয়ম নেই বলে এরকম ক্ষেত্রে চেয়েও ভ্রূণ নষ্ট করা যেত না৷ সেদিক থেকে আদালতের এই রায়ে অনেকেরই সুরাহা হবে৷ তবে পাশাপাশি কোনো পরিবারে এমন ঘটনা ঘটলে কতটা দুঃখ হতে পারে তার আন্দাজ সবাই করতে পারে না৷’’
এর আগেও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রস্তাব ছিল, ২০ সপ্তাহ সময়সীমাটি বাড়িয়ে ২৪ সপ্তাহ করা হোক৷ শুধু বিবাহিত দম্পতি নয়৷ অবিবাহিত মহিলাদেরও গর্ভপাতের ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রক৷ কিন্তু তাতে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বলেছে, এর ফলে গর্ভপাতের চক্রগুলির বাড়বাড়ন্ত হতে পারে৷ লিঙ্গ নির্ধারণের পর ভ্রূণ হত্যাও বাড়তে পারে৷ দু'পক্ষের টানাটানির ফলে বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...