ভোটে নয় নির্বাচন হয় বাছাইয়ে
২৪ মার্চ ২০২৩এ নিয়ে স্লোগান-পাল্টা স্লোগান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ধাক্কাধাক্কিও চলছিল৷ ঝামেলার আঁচ পেয়ে আরো আগে থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা ছিল৷ বেলা পৌনে ১২টার দিকে পুলিশ অ্যাকশনে যায়৷ পিটিয়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হয় মিলনায়তন থেকে৷ এমনকি বিএনপিপন্থি প্রার্থীদেরও বের করে দেয়া হয়৷ পুলিশের হামলায় আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন৷ পুলিশের এই হামলার ঘটনাটি ঘটেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে৷ এটা নয়াপল্টন বা প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা নয় যে, পুলিশকে পিটিয়ে রাস্তা খালি করতে হয়েছে৷ এখানে বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত৷ নির্দিষ্ট পোশাক দিয়ে আইনজীবীদের চেনা যায়৷ সাংবাদিকদের হাতেও ক্যামেরা, বুম বা গলায় পরিচয়পত্র থাকে৷ তাই পুলিশ না চিনে বা না জেনে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পিটিয়েছে, এমনটা মনে করার কোনো করার কোনো কারণ নেই৷ পুলিশ জেনে-বুঝে, টার্গেট করেই আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পিটিয়েছে এবং প্রতিপক্ষকে বের করে দিয়ে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের জন্য নির্বাচনের মাঠ ফাঁকা করে দিয়েছে৷ তারপরও দফায় দফায় উত্তেজনায় শেষ হয়েছে দুদিনের ভোট৷ ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে৷ আওয়ামী লীগপন্থিরা নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে৷
নির্বাচন প্রসঙ্গে পরে আসছি৷ আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশের নজিরবিহীন হামলার কথা বলে নেই৷ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে পুলিশের হামলার ছবি দেখতে দেখতে এক বন্ধু জানতে চাইছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কি পুলিশ এভাবে হামলা চালাতে পারে৷ তিনি উদাহরণ দিয়ে বললেন, জাতীয় সংসদ চত্বরে পুলিশ ঢুকতে হলে স্পিকার বা সার্জেন্ট অ্যাট আর্মসের অনুমতি লাগে৷ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ঢুকতে হলে ভিসি বা প্রক্টরের অনুমতি লাগে৷ তেমনি সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে পুলিশ ঢুকতে বা অ্যাকশনে যেতে নিশ্চয়ই প্রধান বিচারপতি বা রেজিস্ট্রারের অনুমতি লাগে৷ তারা কি পুলিশকে ডেকেছেন বা অনুমতি দিয়েছেন৷ বন্ধুর প্রশ্নটি খুব যৌক্তিক৷ কিন্তু উত্তর আমার জানা নেই৷ এ ধরনের কোনো আইন আছে কিনা জানি না৷ তবে কিছু রেওয়াজ আছে, যা আইনের চেয়ে কম নয়৷ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এ ধরনের কিছু রেওয়াজ আছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় সেই মর্যাদা হারিয়েছে অনেক আগেই৷ এখন পুলিশ যখন-তখন যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে যে কাউকে পিটিয়ে দিতে পারে৷ সুপ্রিম কোর্ট ও সংসদ, অর্থাৎ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান দুটি নিজেদের মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য এতদিন ধরে রেখেছিল৷ কিন্তু ১৫ মার্চ পুলিশের নজিরবিহীন হামলায় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের মর্যাদাও ক্ষুন্ন হলো৷ আমি সেই বন্ধুকে সান্ত্বনা দিলাম, এখন আর বাংলাদেশে এসব আইন, রেওয়াজ মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ সবকিছু এখন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে৷ গণমাধ্যম দেখলেও মনে হতে পারে, এই হামলাও আর ১০টি হামলার মতই স্বাভাবিক ঘটনা৷ ঐ যে বললাম, আমাদের সহ্য ক্ষমতা বেড়ে গেছে৷ সবকিছু এখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়৷ কথায় কথায় আমরা ‘নজিরবিহীন' শব্দটি ব্যবহার করি বটে৷ কিন্তু কখনো কখনো স্মৃতিও আমাদের সাথে প্রতারণা করতে পারে৷ তাই আইনজীবীদের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, ‘‘আইন পেশা পরিচালনার জীবনে আমি কখনো এমনটি দেখিনি৷ এটি দুঃখজনক৷'' বিএনপিপন্থি আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তা ন্যক্কারজনক৷ আইনজীবী হিসেবে আমার পেশাগত জীবন পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি৷ আমি এ রকম ঘটনা এর আগে কখনো দেখিনি৷'' আর বামপন্থি হিসেবে পরিচিত সিনিয়র আইনজী জেড আই খান পান্না বলেছেন, ‘‘পুলিশ যেভাবে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের মারধর করেছে, তা ন্যক্কারজনক৷ সামরিক শাসনের সময়েও পুলিশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এ রকম কাজ করার সাহস পায়নি৷ এই দিনটি একটি কলঙ্কিত দিন, এর জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত৷’’ এরপর আর আমাদের বলার কিছু নেই৷ সত্যি অনেককিছুই আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে৷
এবার আসি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে৷ গত ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য৷ একে একে সে আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠনেও৷ এই সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বাইরে ছিল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি৷ গত নির্বাচনে সভাপতি ও সম্পাদকসহ সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবীরা৷ অপর সাতটি পদে জয় পেয়েছিলেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা৷ কিন্তু এবার ফাঁকা মাঠে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে আওয়ামীপন্থিরা৷ বিএনপিপন্থিরা কার্যত নির্বাচন বর্জন করেছে৷ ভোটগ্রহণের দুদিন তারা মার খেয়েছে, মামলা খেয়েছে, বিচার দিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে; কিন্তু প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়নি৷ তারপরও অবশ্য বিএনপিপন্থি প্রার্থীরা কিছু ভোট পেয়েছেন৷ সভাপতি পদে আওয়ামীপন্থি মোমতাজ উদ্দিন ফকির তিন হাজার ৭২৫ ভোট পেয়ে সভাপতি হিসেবে পুননির্বাচিত হয়েছেন৷ আর বিএনপিপন্থি মাহবুব উদ্দিন খোকন পেয়েছেন ২৯৩ ভোট৷ সম্পাদক পদে আওয়ামীপন্থি আবদুন নূর পেয়েছেন তিন হাজার ৭৪১ ভোট, আর বিএনপিপন্থি রুহুল কুদ্দুস পেয়েছেন ৩০৯ ভোট৷ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন পরিচালিত হয় একটি উপকমিটির মাধ্যমে৷ শুরুতে আওয়ামীপন্থি ও বিএনপিপন্থিরা উপকমিটির আহবায়ক হিসেবে আলাদা আলাদা প্রার্থীর নাম দিয়েছিলেন৷ শেষে দুই পক্ষই নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আহবায়ক হিসেবে মনসুরুল হক চৌধুরীকে মেনে নেয়৷ ২ মার্চ তিনি দায়িত্ব নেন৷ কিন্তু নির্বাচনের এতদিন আগে, ১৩ মার্চ তিনি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করলে জটিলতা তৈরি হয়৷ আওয়ামী লীগপন্থিরা উপকমিটির নতুন আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন৷ আর বিএনপিপন্থিরা মনোনয়ন দেয় এ এস এম মোকতার কবির খানকে৷ এই সমস্যা না মিটিয়েই নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়৷ নির্বাচনের আগের রাতে মনিরুজ্জামান ব্যালট পেপারে সই দিতে গেলে বিএনপিপন্থিরা বাধা দেয়৷ তারা কিছু ব্যালট পেপার ছিনিয়েও নেয়৷ এই জটিলতাই নির্বাচনের দিন সংঘর্ষে গড়ায়৷ মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যে নির্বাচন কার্যত বর্জন করে বিএনপিপন্থিরা৷
আমার ধারণা ছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে সকল পর্যায়ের নির্বাচন সুষ্ঠু করার একটা চেষ্টা করবে বর্তমান সরকার৷ যাতে দেশে-বিদেশে ‘বর্তমান সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব’ এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যায়৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আমার সে ধারণায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে৷ এটা এখন পরিস্কার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মাঠ সমতল ছিল না; ফলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি৷ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি পুরোপুরি দখলে নিতে সরকার কিছুটা সময় নিয়েছে৷ অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএমএ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিউশন, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, রিহ্যাবসহ এ ধরনের সকল সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানেই এখন সরকারপন্থিরা নিরঙ্কুশ আধিপত্য৷ কোথাও নামকাওয়াস্তে ইলেকশন হয়, কোথাও সিলেকশন হয়৷ যাই হোক, সবই থাকে পূর্বনির্ধারিত৷ একসময় জাতীয় প্রেসক্লাবে বিএনপিপন্থিদের আধিপত্য ছিল৷ অনেক দিন নতুন সদস্য নেয়া বন্ধ থাকায় বিএনপিপন্থিদের জিততে অসুবিধা হতো না৷ একবার আওয়ামীপন্থিরা একসাথে অনেক সদস্য বানিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তোলে৷ এরপর থেকে প্রেসক্লাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় এবং সরকারপন্থিরা জয় পায়৷
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-বিএনপি এই দুই ধারায় বিভক্ত৷ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন অনেক কোনঠাসা, তারপরও আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ তারাই৷ মূল রাজনীতির এই বিভক্তি প্রবাহিত হয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ সব পেশায় এখন এই বিভক্তি প্রবলভাবে দৃশ্যমান৷ পেশাজীবীদের মধ্যে রাজনৈতিক সমর্থন আগে থেকেই ছিল৷ কিন্তু সবাই প্রায় মূল দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়েছে৷ পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনের প্রার্থী মনোনয়নও দলীয় বিবেচনায় দলের সিদ্ধান্তে হয়৷ ফলে রাজনীতিবিদ আর পেশাজীবীদের মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ কিন্তু একসময় এই পেশাজীবীরাই দেশের গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো৷ কিন্তু এখন গণতন্ত্রেরই ভারসাম্য নেই, পেশাজীবীদেরও তাই কোনো ভূমিকা নেই৷ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন গণতন্ত্রকে বড় সঙ্কটে ফেলেছে৷ সংসদে প্রধান বিরোধী দল গৃহপালিত, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল কোনঠাসা৷ এ অবস্থায় মূল রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সঙ্কট নিরসনে সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যবসায়ীরা বড় ভূমিকা রাখতে পারতেন৷ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দলের মধ্যে আলোচনার পরিবশে সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখতে পারতেন পেশাজীবীরা৷ দুর্ভাগ্য আমাদের পেশাজীবীরাই আরো বেশি করে রাজনীতিবিদ হয়ে উঠছেন৷ জাতীয় নির্বাচনের স্টাইল অনুসৃত হচ্ছে পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের সংগঠনেও৷