রাজনীতির জগতটা বড়ই বিচিত্র। এই যে রেবন্ত রেড্ডি বৃহস্পতিবার তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন, তাকে ২০১৮ থেকে পুলিশ নয়বার গৃহবন্দি করেছে। প্রশ্ন ফাঁস মামলায় তাকে পুলিশ জেরা করেছে। বারবার তাকে পুলিশ ডেকে পাঠিয়েছে৷ এখন সেই পুলিশই তাকে উঠতে-বসতে সালাম দেবে৷ গত ২৪ মার্চও তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল পুলিশ৷ অভিযোগ, কোনো আন্দোলনে যোগ দিতে গেলেই তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হত৷
আর এই লড়াকু নেতার বৈশিষ্ট্য হলো, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করা৷ প্রতিবাদ জানানো৷ আজ সেই রেবন্তই মুখ্যমন্ত্রী৷ আর যিনি রেবন্তকে বারবার গৃহবন্দি করেছেন, সেই কে চন্দ্রশেখর রাও দুইবার মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর এবার ক্ষমতা হারিয়েছেন৷ এবার রেবন্তও যদি তাকে বারবার গৃহবন্দি করেন, পুলিশ গিয়ে নানা কেলেঙ্কারিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, ভোটের আগে তাকে বাড়িতে আটক করে রাখে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ এমনিতে ভারতীয় ভোটদাতারা প্রতিহিংসা ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করেন না৷ কিন্তু তাও রাজনৈতিক নেতারা হামেশাই এই কাজ করে থাকেন৷ ভোটের আগে তো এই ঘটনা হামেশাই দেখা যায়৷
রাজস্থানে বিধানসভা নির্বাচনের আগে অক্টোবরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গোবিন্দ রাও দোতারসার জয়পুর ও সিকরের বাড়িতে তল্লাশি চালায় ইডি৷ তিনি তখন নির্বাচনী প্রচার করছিলেন। অভিযোগ ছিল, দোতারসার বাড়ি থেকে শিক্ষকদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে৷ একই কারণে কংগ্রেস বিধায়ক ওমপ্রকাশ হুডলার বাড়িতেও তল্লাশি চলে। পরে দোতারসার দুই ছেলেকে সমন পাঠায় ইডি৷
কাছাকাছি সময় অশোক গেহলটের ছেলেকেও ইডি সমন পাঠায়। তখন গেহলটের অভিযোগ ছিল, প্রতিদিন নির্বাচনী প্রচারের মধ্যে ইডি-র সমন আসছে৷
ছত্তিশগড়েও গত অগাস্টের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সাংবাদিক বিনোদ বর্মা ও দুই অফিসারের বাড়িতে তল্লাশি করে ইডি৷ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বের চারদিন আগে মহাদেব বেটিং অ্যাপের সঙ্গে পরাজিত মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের সম্পর্কের কথা জানায় ইডি৷ তারা বলে, বাঘেল ওই অ্যাপের কাছ থেকে ৫০৮ কোটি টাকা পেয়েছেন৷ ২০২২ সালের জুলাই থেকে ইডি অবশ্য এই মামলার তদন্ত করছে৷
এসব নিয়ে অনেক জলঘোলা ও বিতর্ক আছে, আমরা শুধু একটা কথাই বলতে পারি, যদি কোনো কেলেঙ্কারি থাকে, তা নিয়ে ইডি, সিবিআই বা অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে, তাহলে অভিযুক্ত রাজনীতিককে জেরা করা, তল্লাশি করার সম্পূর্ণ অধিকার তাদের আছে৷ তারা তদন্তের প্রয়োজনে যে কোনো সময়ে তা করতে পারেন। তদন্তের কাজ কীভাবে করবেন, কখন করবেন, সেসব তাদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের বিষয়৷
বিরোধীদের অভিযোগ, কোনো নির্বাচন এলে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে এই সব তদন্তের গতি বেড়ে যায়৷ তাদের বাড়িতে তদন্তকারীরা তল্লাশি করেন৷ এর ফলে মানুষের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়৷ রাজনীতি তো ধারণা তৈরির খেলা। ফলে বিরোধীরা বেকায়দায় পড়েন৷ তবে ঘটনা হলো, এই সব কেলেঙ্কারি তো হাওয়ায় জন্ম নেয় না৷ কেলেঙ্কারি থাকলে তার তদন্ত হবে৷ যদি এই সব কেলেঙ্কারি না থাকত, তাহলে তদন্তেরও প্রয়োজন হত না৷ এই সব অভিযোগ ওঠারও সুযোগ থাকত না৷ আর রাজনীতিতে কোন অস্ত্র কখন ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়, যে কোনো ঝানু রাজনীতিক তা জানেন৷ ফলে তারা সেভাবেই অস্ত্র ব্যবহার করেন৷ পশ্চিমবঙ্গে যদি শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি না হত, কয়লা কেলেঙ্কারি না হত, তাহলে সিবিআই ও ইডিও তো এই তৎপরতা দেখাত না৷ তারা তো এক্ষেত্রে আবার হাইকোর্টের নির্দেশে কাজ করছে।
এমনিতে ভোটের আগে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করে নেয়া, তারা যাতে মনোনয়নপত্র পেশ করতে না পারেন, তার চেষ্টা করা, বা বিরোধীশূণ্য ফাঁকা মাঠে ভোট করার চেষ্টা বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে হয় না৷ সেসব পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ভোটে হয়৷ তার বাইরে এসব ঘটনা ঘটে না৷ বরং অতীতে জেলে থাকাকালীন উত্তরপ্রদেশে অনেক বাহুবলী নির্বাচনে জিতেছেন এমন বহু নজির আছে৷
ভোটের আগে বিরোধী নেতাদের ধরে ধরে গ্রেপ্তার করার ঘটনা বিরল। এমনকী জরুরি অবস্থার পর যখন নির্বাচনের ঘোষণা করা হয়, তার আগে বন্দি সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷ ফলে ভোটে অংশ নিতে তাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। নিয়মানুযায়ী শাস্তিপ্রাপ্তরা ভোটে লড়তে পারেন না বা শাস্তি পেলে তাদের ইস্তফা দিতে হয়৷ যেমন হয়েছিল রাহুল গান্ধীকে। যেমন লালুপ্রসাদ ভোটে দাঁড়াতে পারেন না৷
তবে ভোট এলে বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে তদন্তের গতি বেড়ে যায় এই অভিযোগ বিরেোধীরা দীর্ঘদিন ধরে করছেন৷ পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালের দুইটি কেলেঙ্কারি সারদা ও নারদের ক্ষেত্রে একই অভিযোগ ওঠে৷ এই দুইটিই প্রতিষ্ঠিত কেলেঙ্কারি৷ সারদায় তো অসংখ্য মানুষ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন৷ তারপরেও সেই তদন্ত চলছে তো চলছেই৷ মাঝেমধ্যে তা নিয়ে হইচই হয়৷ আবার তা থিতিয়ে যায়৷ এখন তো পশ্চিমবঙ্গ বেআইনিভাবে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সরগরম। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে নয়ছয় করার অভিযোগও আছে৷ লোকসভা ভোটের আগে যদি এই সব তদন্তে গতি আসে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷
এমনও নয়, ঘটনাটা সাম্প্রতিককালে হচ্ছে৷ ইউপিএ আমলে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী ও মুলায়ম সিং যাদবের বিপুল আয়ের উৎস খোঁজার জন্য তদন্ত ভোটের আগেই গতি পেত বলে সমাজবাদী পার্টি ও বিএসপি বরাবর অভিযোগ করে এসেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদীকে সারাদিন ধরে জেরা করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা৷ তখন বিজেপি-ও একই অভিযোগ করেছে৷ জরুরি অবস্থার পর ক্ষমতায় এসে ইন্দিরা গান্ধীকে জেলবন্দি করার জন্য জনতা দল নেতারা এমন তৎপরতা দেখিয়েছিলেন, যাতে বোঝা যাচ্ছিল, ইন্দিরা যেমন তাদের জেলে পাঠিয়েছিলেন, ঠিক সেই কাজটা যতক্ষণ না করছেন, ততক্ষণ তারা শান্তি পাচ্ছেন না৷ এভাবে ইন্দিরাকে জেলে পাঠিয়ে কোনো লাভ হয়নি৷
কিন্তু এখনও কি সেই কথাটাই খাটে? এখন প্রধানমন্ত্রী মোদী একটা ন্যারেটিভ তৈরি করেছেন, সেটা হলো, বিরোধী দল ও নেতাদের বেশিরভাগই দুর্নীতিগ্রস্ত। এরপর যদি তাদের বাড়িতে ইডি, সিবিআই তল্লাশি করে, তখন জনমানসে সেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না। ফলে ভোটের আগে দুর্নীতির এই চেহারা দেখিয়ে মোদী রাজনৈতিকভাবে লাভবান হন৷
সোনিয়া, রাহুল ও মল্লিকার্জুন খাড়গের বিরুদ্ধে ন্যাাশনাল হেরাল্ডের মামলায় তদন্ত চলছে, কেজরিওয়ালকে মদের লাইসেন্স কেলেঙ্কারি নিয়ে ইডি ডেকে পাঠিয়েছিল৷ কেজরিওয়াল যাননি৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডি বেশ কয়েকবার ডেকেছে৷ তার স্ত্রীকেও ডাকা হয়েছে৷ ফলে লোকসভা ভোটের আগে তাদের মামলা নিয়েও নড়াচড়া বেশি হতেই পারে৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে আপ ক্ষমতায় এসেছিল৷ তাদের দুই সাবেক মন্ত্রী এখন জেলে৷ তারমধ্যে একদা মন্ত্রিসভার দুই নম্বর ব্যক্তি মনীশ সিসোদিয়াও আছেন। তাদের প্রচুর বিধায়ক কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছেন৷ তাই তাদের সেই ভাবমূর্তি আর নেই৷ তারপরেও যে কেজরিওয়াল জিততে পেরেছেন, তা তার নিজের ভাবমূর্তি ও জনমোহিনী প্রকল্পের জন্য৷
অফ স্টাম্পের বাইরে লোপ্পা বল দিলে চার বা ছয় হতেই পারে৷ ভারতীয় রাজনীতির প্রবাদ বলছে, এত কেলেঙ্কারি যদি প্লেটে সাজিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হয়, তাহলে ভোটের আগে তা নিয়ে আলোড়ন হবে, হবেই৷