তৃণমূলের বিধায়ক, নেতাদের বাড়িতে সিবিআই তল্লাশি
৩০ নভেম্বর ২০২৩কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বুধবার কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় সভা করেন। সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া কথা শুনিয়েছেন শাহ। তার পরের দিনই সিবিআই তদন্তকারীরা ফের অভিযানে। তৃণমূলের বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের বাড়িতে সিবিআই তল্লাশি চালাচ্ছে। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার হয়েছে। সিবিআই কর্মকর্তারা সেখানে টাকা গোনার মেশিন নিয়ে ঢুকেছেন।
তৃণমূল বিধায়ক অদিতি মুন্সীর স্বামী ও বিধাননগরের কাউন্সিলার দেবরাজ চক্রবর্তীর দুইটি বাড়িতে তল্লাশি করছে সিবিআই। তল্লাশি করা হয়েছে, কলকতা পুরসভার কাউন্সিলার বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের বাড়িতে। কোচবিহারের তৃণমূল নেতা সজল সরকারের বাড়িতেও তারা তল্লাশি চালিয়েছেন।
কলকাতায় অভিযান
স্কুলে শিক্ষক ও অন্যান্য পদে নিয়োগ দুর্নীতিতে একগুচ্ছ মামলা চলছে। আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সংস্থা এই দুর্নীতিতে তদন্ত চালাচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তির জন্য সময় বেধে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। তদন্ত চলছে অন্যান্য দুর্নীতি মামলারও। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় শুরু হয় কেন্দ্রীয় সংস্থার অভিযান। কলকাতায় নজরে দুই কাউন্সিলর।
পাটুলিতে কলকাতা পুরসভার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তর বাড়িতে তল্লাশি করে সিবিআই। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ শুরু হয় তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ। নিয়োগ দুর্নীতিতে এক বছরের বেশি সময় কারাবন্দি পার্থ।
বিধাননগর পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দেবরাজ চক্রবর্তীর বাগুইআটির বাড়িতে তল্লাশি করেন কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকরা। সকাল সোয়া নটার কিছু আগে রাজারহাটে দেবরাজের বাড়িতে যান তারা। তখন দেবরাজ বাড়িতে ছিলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি চলে আসেন।
পরে মেয়র পারিষদ দেবরাজকে নিয়ে তার অন্য একটি বাসভবন সল্টলেকে যান তদন্তকারীরা। তিনি শাসক দলের বিধায়ক অদিতি মুন্সির স্বামী। এর আগেও একটি মামলায় দেবরাজকে তলব করেছিল সিবিআই।
নজরে বিধায়ক
মুর্শিদাবাদে ডোমকলের তৃণমূল বিধায়ক জাফিকুল ইসলামের বাড়িতে অভিযান চালায় সিবিআই। গোবিন্দপুরে তার দলীয় কার্যালয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সাবেক সভাপতি ও তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
বিধায়কের বাড়ির এক কিলোমিটার দূরে তার শিক্ষা হাব। একই চত্বরে ছয়-সাতটি কলেজ রয়েছে। শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ ছাড়াও পলিটেকনিক কলেজ রয়েছে হাবে। কলেজে গিয়ে নথি পরীক্ষা করেন আধিকারিকরা। গরু পাচার মামলায় এর আগে বিধায়ককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই। তিনি এনআইএ-র প্রশ্নের মুখেও পড়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদের বড়ঞাতে অভিযান চালান তদন্তকারীরা। ভোর ছটার কিছু পরে বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের ‘ঘনিষ্ঠ' ঝণ্টু শেখের বাড়িতে যায় সিবিআই। ব্যবসায়ী ঝন্টু একাধিক বিএড কলেজের সঙ্গে যুক্ত বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। কুন্তল শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতিতে দীর্ঘদিন জেলবন্দি। তদন্তকারীদের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে যে বিপুল আর্থিক লেনদেন হয়েছে, তার তত্ত্বাবধানে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম কুন্তল।
কোচবিহারে অভিযান
উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে দুই নম্বর ব্লকে হানা দেন আধিকারিকরা। এই ব্লকের তৃণমূল সভাপতি সজল সরকারের বাড়ি যান তারা। এর কাছেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার শ্যামল করের বাড়ি। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। কর পরিচালিত বিএড কলেজে যান তদন্তকারীরা। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় শ্যামল ও তার ভাইকে।
তৃণমূল এই অভিযানকে 'চক্রান্তের' তকমা দিয়েছে। মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, ''এজেন্সি দিয়ে হেনস্থা করে বিজেপির লাভ হবে না। এভাবে তৃণমূলকে হারানো যাবে না। ওরা পায়ের নীচে মাটি নেই। যত অভিযান করবে, তত মানুষের মনে তৃণমূল জায়গা বাড়বে।''
বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ''রাজ্যের মানুষ চাইছেন, দ্রুত তদন্ত শেষ হোক। আমরাও তাই চাইছি। আদালত তেমনই নির্দেশ দিয়েছে। সেই অনুসারে তদন্তকারীরা কাজ করছেন। একে চক্রান্ত বলে দুর্নীতি চাপা দেয়া যাবে না।''
রাজনৈতিক কৌশল?
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কৌঁসুলি আদালতে বলেছিলেন, নিয়োগে দুর্নীতির জাল যেভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, তাতে সব স্তরের যোগ পাওয়া যাচ্ছে। পিরামিডের মতো উপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিভিন্ন চক্র কাজ করেছে। নির্ধারিত ছয় মাসের মধ্যে এসব রহস্য তদন্তকারীরা ভেদ করতে পারবেন কি না, সেই সংশয় রয়েছে।
বাম ও কংগ্রেসের অভিযোগ, তৃণমূল ও বিজেপির গোপন বোঝাপড়ায় পিরামিডের উপরতলায় হাত বাড়াচ্ছে না সিবিআই। লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত এই তৎপরতা বজায় থাকবে বলে মনে করেন প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র।
তিনি বলেন, ''দেশ জুড়ে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিজেপি বোঝাতে চাইছে, তারা ছাড়া সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। সব রাজ্যে তৎপরতা বাড়াচ্ছে সিবিআই, ইডি। কিন্তু এই কৌশল কাজে আসবে বলে মনে হয় না। ২০১৪-র ভোটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচার যতটা কাজে এসেছিল, এবার তা হওয়ার সম্ভাবনা কম।''
তবে কোটি কোটি নগদ টাকা উদ্ধার, ব্যাঙ্কে বিপুল ডিপোজিট, হঠাৎ সম্পত্তি বৃদ্ধির মতো তথ্য তৃণমূলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, যা আপ সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা তার সঙ্গীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে শুভাশিস বলেন, ''এই তথ্যগুলো বলে দিচ্ছে অনিয়ম কিছু আছে। মানুষ দুর্নীতির কথা বিশ্বাস করছে। সেটা তদন্তকারীদের বার করতে হবে। তবে শাহের সভার সঙ্গে এই অভিযানের সম্পর্ক নেই। বেশ কিছুদিন ধরে এই তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।''