নিম্নমানের ওষুধ বিপর্যয় ডেকে আনছে
২৭ মার্চ ২০১৭ভেজাল প্যারসিটামল সিরাপ সেবনের কারণে ২০০৯ সালের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কিডনি নষ্ট হয়ে ২৮ শিশু মারা যায়৷ সংবাদমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এই খবর প্রকাশ হয়৷ এরপর ২২শে জুলাই কারখানাটি বন্ধ করে দেয় ওষুধ প্রশাসন৷ এ ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই প্যারসিটামল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘রিড ফার্মা' সিরাপে বিষাক্ত পদার্থ ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করছিল৷ বলা বাহুল্য, উৎপাদন ব্যয় কমাতেই তারা প্রোপাইলিন গ্লাইকনের পরিবর্তে বিষাক্ত ডাই-ইথানল গ্লাইকল ব্যবহার করে, যা শিশুদের মৃত্যু ডেকে আনে৷ সে সময় রিড ফার্মার রিডাপ্লেক্স (ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স সিরাপ) এবং টেমসেট (প্যারাসিটামল সাসপেনশন) নামে দু'টি ওষুধ নিষিদ্ধও করা হয়৷
এই ঘটনায় মামলা হয়৷ কিন্তু দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে মামলার আসামি রিড ফার্মার মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান, মিজানুর রহমানের স্ত্রী রিড ফার্মার পরিচালক শিউলি রহমান, পরিচালক আবদুল গনি, ফার্মাসিস্ট মাহবুবুল ইসলাম ও এনামুল হক ড্রাগ আদালত থেকে খালাস পান, যা বিস্মিত করে সংশ্লিষ্টদের৷ তাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তাঁরা৷ গত ৯ই মার্চ হাইকোর্ট আপিল গ্রহণ করে এই মামলায় খালাসপ্রাপ্তদের সাতদিনের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলে৷ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, ‘‘খালাসের রায়টি যুক্তিযুক্ত ছিল না মনে হওয়ায় আমরা যথাযথ ও পর্যাপ্ত সাজা চেয়ে আবেদন জানিয়েছি৷''
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের একটি তালিকা তৈরি করে৷ তালিকা করে ভেজাল ওষুধেরও৷ প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলেও পরে ঐ তালিকা ধরে হাইকোর্টে একাধিক রিট করা হয় এবং প্রতিকার পাওয়া যায়৷
২০১৪ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে৷ কমিটি দেশের ৮৪টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন শেষে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়৷ এর মধ্যে ৬২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিলসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে তারা৷ এছাড়া ২০টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয় আর ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করার কথা বলা হয়৷ কিন্তু ওধুধ প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিষয়টি আদালতে গড়ায়৷
বিশেষজ্ঞ কমিটি এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো ক্যামিকেল, রিদ ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুন ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড – এই ২০টি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়৷
সংসদীয় কমিটি ১৪টি প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) উৎপাদনের অনুমতি বাতিল এবং ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদনের অনুমতি স্থগিত করার সুপারিশও করে৷
সংসদীয় কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘ওষুধ উৎপাদনকালে জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ না করলে উৎপাদিত ওষুধ মানসম্পন্ন হয় না, ব্যবহারকারীর অসুখ না সেরে বরং শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, যে ক্ষতি প্রাণঘাতীও হতে পারে৷ তাই এই ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য সার্বিক বিবেচনায় পরিতাজ্য৷'
জিএমপি হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস নীতিমালা৷ প্রশাসন এই ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে এরপরও ব্যবস্থা না নেওয়ায়, শেষ পর্যন্ত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে দু'দফায় ৩৪টি কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল এবং ২৮টি কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন, হরমোন ও অ্যান্টি-ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷
এ নিয়ে বাংলাদেশে মোট ৬২টি কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলো আদালতের নির্দেশে৷
হাইকোর্টে রিটকারী ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ'-এর প্রধান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরও সংবাদমাধ্যমে খবর আসতে থাকে যে, ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ওষুধ এবং নিষিদ্ধ ওষুধ উৎপাদন বন্ধ হয়নি৷ তখন আমরা আদলতে যাই এবং কয়েকটি আবেদন করে সুপারিশের পুরোটাই আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়নের আদেশ পাই৷''
তিনি বলেন, ‘‘সর্বশেষ ২৭শে ফেব্রুয়ারি আদালত বাংলাদেশের ২৮টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পেনিসিলিন, হরমোন ও অ্যান্টি-ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে৷ আজ (২০-০৩-১৭) ওষুধ প্রশাসন আদালতকে জানিয়েছে৷ ঐ ২৮টি কোম্পানির পেনিসিলিন, হরমোন ও অ্যান্টি-ক্যানসারের ওষুধ উৎপাদন এবং বিপণন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷''
মনজিল মোরসেদের কথায়, ‘‘যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারা যখন ব্যবস্থা নেয়নি, তখন আমরা মানুষের জীবন বাঁচাতে আদালতে যেতে বাধ্য হয়েছি৷''
সংসদীয় কমিটির উদ্যোগে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ছ'টি সুপারিশ করেছিলাম৷ ১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিএমপি মান অনুসরণ না করায় ২০টি কেম্পানির লাইসেন্স বাতিল, ২. ১৪টি কোম্পানি কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বনাতে পারবে না, ৩. ২২টি কোম্পানি পেনিসিলিন গ্রুপের ওষুধ বানাতে পারবে না, ৪. একটি কোম্পানি হিউম্যান ড্রাগ বানাতে পারবে না, ৫. দু'টি কোম্পানি শুধু বাহ্যিক ব্যবহারের ওষুধ বানাতে পারবে এবং ৬. তিনটি কোম্পানি অ্যান্টি-ক্যানসার এবং হরমোন ড্রাগ বানাতে পারবে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সুপারিশের পরও বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ তবে হাইকোর্টের নির্দেশের পর শেষ পর্যন্ত তারা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে৷ এতদিন এই প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই চলে আসছিল৷ কারণ কোনো অসাধু প্রক্রিয়া ছাড়া এগুলো চলতে পারার কথা নয়৷''
আ ব ম ফারুক বলেন, ‘‘মানহীন ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়া গণহত্যার সামিল৷ বাংলাদেশে এই মানহীন ওষুধের কারণে অনেকের মৃত্যু হচ্ছে৷ তবে এ নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় সঠিক তথ্য সামনে আসছে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক রোগী, যাঁদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিটেন্স ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকই তাঁদের শরীরের জীবাণু মারতে পারছে না৷ মানহীন অথবা নিম্নমানের অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে৷ এঁদের মৃত্যু অবধারিত৷ শুধু তাই নয়, এঁদের মাধ্যমে জীবাণুও ছড়িয়ে পড়ছে৷''
তাঁর কথায়, ‘‘মানহীন বা নিম্নমানের ওষুধ রোগ না সারিয়ে উল্টে বাড়িয়ে দেয়৷ নতুন রোগ শরীরে বাসা বাঁধে৷ এছাড়া বাংলাদেশের ৫০ ভাগ ওষুধ কোম্পানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুসরণ করছে না৷ এরজন্যও ওষুধ প্রশাসন দায় এড়াতে পারে না৷''
বাংলাদেশে এইসব ভেজাল এবং নিম্নমানের ওষুধ কিন্তু তৈরি করে লাইসেন্স প্রাপ্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই৷ তারা বৈধতার আড়ালে অবৈধ কাজ করে৷ এর বাইরে লাইসেন্স না দিয়ে পুরোপুরি অবৈধভাবে গোপন কারখানায় বিভিন্ন নামি ওষুধ কোম্পনির নকল ওষুধ তৈরি করেও বাজারে ছাড়ার ঘটনা ঘটছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রায়ই এ ধরনের নকল ওষুধের কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়৷
ওষুধ প্রশাসন যেমন ২০১৬ সালে এ ধরনের ১৬টি নকল ওষুধের কারাখানা এবং নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে ২০টি ফার্মেসি বন্ধ করে দেয়৷ তারা ১৬ কোটির বেশি টাকার নকল, ভেজাল ও অরেজিস্টিকৃত ওষুধ উদ্ধার করে৷ এই ঘটনায় জড়িত ৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে৷ ভ্রাম্যমান আদালত বিভিন্ন সময় ৬ কোটিরও বেশি টাকা জরিমানা আদায় করেছে৷ মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ওষুধ আদালতে ২ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে৷
আ ব ম ফারুক বলেন, ‘‘বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ এখন বিদেশেও রপ্তানি হয়৷ এখানে উচ্চমানের ওষুধ যেমন আছে, আছে মানহীন ওষুধও৷ আর এই মানহীন ওষুধ যে শুধু ছোট কোম্পানি তৈরি করে, তা নয়৷ এর সঙ্গে বড় কোম্পানিও জড়িত৷''
প্রসঙ্গত, ২৫৭টি রেজিস্টার্ড অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ১৯৪টি ওষুধ উৎপাদন করছে৷ বাংলাদেশের ওষুধ এখন বিশ্বের ১০৯টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে৷ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ কোটি ২৬ লাখ ডলারের ওষুধ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷