1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভেঙে পড়া বাড়ি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ পুরসভা ও রাজ্য সরকার

২০ মার্চ ২০২৪

গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে মৃত্যু বেড়ে ১০। আশপাশের এলাকায় আরো বিপজ্জনক বাড়ির সন্ধান। বেআইনি বাড়ির খোঁজে পথে পুরসভা।

https://p.dw.com/p/4dswk
গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বাড়ি।
কলকাতার গার্ডেনরিচে একটি বেআইনি বাড়ির একাংশ পাশের টালির টালের বাড়ির উপর ভেঙে পড়ে। ছবি: Subrata Goswami/DW

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বাড়িটি বেআইনিভাবে বানানো হচ্ছিল। তারপর প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন কীভাবে চলছিল অবৈধ কাজ? কলকাতায় এরকম কত বাড়ি আছে? একেকটা বাড়ি ভেঙে পড়ার পর একটু নড়াচড়া হয়, তারপর আবার রাজ্য সরকার ও পুরসভা চুপ করে যায় কেন?

বেআইনি নির্মাণ নিয়ে হাইকোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে রাজ্য সরকার। অন্য একটি বেআইনি নির্মাণ নিয়ে বিচারপতি অমৃতা সিনহা প্রশ্ন করেছেন, ‘‘ একটি বাড়ি কয়েক সেকেন্ডে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। আর একটি বাড়ির বাইরের অংশ ৩০ দিনেও কেন ভাঙা গেল না!' 

বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে কেন এত সময় লাগছে?

একবালপুরের একটা বেআইনি বাড়ির বাইরের অংশ ভেঙে দেয়ার জন্য ৩০ দিন আগে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। কিন্তু এখনো তা ভাঙা হয়নি। বিচারপতি সিনহার প্রশ্ন, বেআইনি নির্মাণ ভাঙার জন্য ৩০ দিন যথেষ্ট নয় কি?  পুরসভার আইনজীবী বলেন, ভাঙার যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে দেরি হওয়ায় বাড়ি ভাঙা যা্য়নি। বিচারপতি নির্দেশ দেন, কোন যন্ত্রপাতি দিয়ে পুরসভা বাড়ি ভাঙতে চায়, তা নিয়ে হলফনামা দিক।

বিচারপতি জানিয়ে দিয়েছেন, বেআিনি নির্মাণ ভাঙা নিয়ে যে আদালতই নির্দেশ দিক, তাতে তিনি স্থগিতাদেশ দেবেন না।

গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বাড়ির প্রমোটারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বেআইনি নির্মাণ

গার্ডেনরিচের পাহাড়পুরে যে বহুতল ভেঙে পড়েছে, তা তৈরি হয়েছিল একটি জলাশয়ের একাংশ বুজিয়ে। পুরসভাই বলেছে, অনুমোদন ছাড়া এই বহুতল নির্মাণের কাজ চলছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। চার ফুট রাস্তার ধারে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণের ছাড়পত্র পুরসভার দেয় না। অথচ এখানে বছর দেড়েক ধরে বেআইনি নির্মাণ চলছিল।

এই বহুতল নির্মাণকারী প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিমকে গার্ডেনরিচ থানা গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে খুন, খুনের চেষ্টা, নির্মাণে গাফিলতি সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। এই বহুতলে ১৬টি ফ্ল্যাট ছিল। তার প্রতিটি নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।

এলাকার কাউন্সিলর শামস ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। ইকবালের দাবি, এই বেআইনি নির্মাণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তার পাশে কার্যত দাঁড়িয়েছেন মেয়র ফিরহাদ। বলেছেন, কোথায় বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে তা কাউন্সিলরের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। এটা দেখবে প্রশাসন। প্রশ্ন উঠেছে, সেই পুর প্রশাসনের মাথায় তো রয়েছেন খোদ মেয়রই!

মৃত্যুর দায় কার?

অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় সরকারি আধিকারিকদের উপর চাপানোর চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে পুরসভা শোকজ করেছে সংশ্লিষ্ট এলাকায় নির্মাণ কার্যের নজরদারিতে থাকা একাধিক ইঞ্জিনিয়ারকে। যদিও ফিরহাদের পূর্বসূরি, তৃণমূল পুর বোর্ডের সাবেক মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, "এখানে পুর আধিকারিকরা নজরদারি করতেই পারেন না।"

একটি বহুতলে বিপর্যয়ের পর একের পর এক বেআইনি নির্মাণের নমুনা সামনে আসছে। গার্ডেনরিচের ৪৭০ নম্বর বাড়ি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এই ভবন বছর ছয়েকের মধ্যে তৈরি হলেও, সেটি পাশের বহুতলের উপর হেলে রয়েছে। বিপদ মাথায় নিয়ে এই বহুতলে বসবাস করছে অনেকগুলি পরিবার। অভিযোগ, ভবনের উপরের তল অনুমতি ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে।

এছাড়া এই এলাকায় আরো পাঁচটি ভবনের খোঁজ পেয়েছে পুরসভা, যেগুলি অনুমোদন ছাড়া তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ উঠেছে, এখানকার একাধিক নির্মাণের ক্ষেত্রে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। নির্মাণের আগে মাটির পরীক্ষা করানো হয়নি। ফলে রবিবারের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অতীতে এ ব্যাপারে কড়া মন্তব্য করেছেন কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 'যোগীরাজ্যের বুলডোজার' সংক্রান্ত সেই মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক হয়েছিল।

টাকার খেলা?

বহুতল বিপর্যয়ের জন্য তৃণমূল প্রশাসনকে নিশানা করেছে বিরোধীরা। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ, "প্রত্যেক এলাকার কাউন্সিলর ভবনের স্কোয়ার ফুট মেপে প্রোমোটারের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। তাহলে কীভাবে বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে তারা কথা বলবেন?"

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, "পয়সা ফেকো, তামাশা দেখো। এখানে পয়সা দিলেই সব কাজ হয়। তার বাইরে তৃণমূল আর কিছু জানে না।" তৃণমূল কাউন্সিলের অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, "এই পুর বোর্ডের আমলে শয়ে শয়ে বাড়ি বেআইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। নির্মাণ ভাঙা হয়েছে। আইনি ব্যবস্থাও নিয়েছে পুরসভা।"

কাউন্সিলর শামস ইকবালকে গ্রেপ্তারের দাবি তুলেছে বিরোধীরা। তার সঙ্গে ধৃত প্রোমোটারের ছবি সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। আজ দুর্ঘটনাস্থলে যান আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি। তিনি বলেন, "যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, তার পদমর্যাদা যাই হোক না কেন।"

‘নির্মাণকারীদের কাছ থেকে কাউন্সিলর ও বিধায়ক কাটমানি নেন’

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, তারা বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ জানিয়েছেন বেআইনি নির্মাণ সম্পর্কে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সূত্রের খবর, ভূমি সংস্কার দপ্তরের নথিতে যেটি পুকুর হিসেবে চিহ্নিত, সেখানেই বাস্তু ভিটা তৈরি করা হচ্ছিল। এলাকাবাসীর দাবি, গার্ডেনরিচের বিভিন্ন পাড়ায় এমন অনেক নির্মাণ এখনও চলছে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

কলকাতা পুরসভার সাবেক মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "নির্মাণকারীদের কাছ থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর ও বিধায়ক কাটমানি নেন। ফলে প্রোমোটার উৎসাহ পায়। তারা জানে যে, বেআইনি কাজ করা সত্ত্বেও শাসক দলের নেতাদের ম্যানেজ করলে সমস্যা হবে না। এমন মনোভাবের জেরেই এই বিপর্যয়।"

উদ্ধারকাজ আজও

বিপর্যয়ের পর দেড় দিন কেটে গিয়েছে। মঙ্গলবারও জোরকদমে চলেছে উদ্ধারের প্রক্রিয়া। দেখা হচ্ছে ধ্বংসস্তূপের ভিতর কেউ চাপা পড়ে আছে কি না। আজ সকালে স্নিফার ডগ নিয়ে আসা হয় ঘটনাস্থলে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সঙ্গে রাজ্যের বাহিনী, দমকল, পুলিশের তত্ত্বাবধানে উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলেছে। 

ভিতরে কেউ জীবিত অবস্থায় থাকতে পারেন বলে আশা উদ্ধারকারীদের। এখনো একাধিক স্থানীয় বাসিন্দার খোঁজ মিলছে না। ১৫ জনের বেশি হাসপাতালে ভর্তি। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

স্বজনহারানোর শোক

 এই ঘটনায় পরিবারের মানুষদের হারিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা আলী। তিনি আনন্দবাজারে লিখেছেন,  ''এক রাতেই আমার গোটা পরিবার শেষ হয়ে গেল! স্ত্রী, শ্যালিকা, দাদা— কেউ বাঁচল না। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলাম, সবাইকেই দেখেছিলাম, যে যার নিজের কাজ করছে। যখন ফিরলাম, তখন টালির চালের নীচে সবাই চাপা পড়ে। গোঙানি, চিৎকার শুনলেও তিন জনের এক জনকেও বাঁচাতে পারলাম না।''

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷